খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

মানুষের মৃত্যুর পর বর্জনীয় কাজসমূহ (পর্ব- ০২)

হাফেজ মাও. মুফতি জুবায়ের হাসান

বিলাপ করা
মা-বাবার জন্য সন্তানের বিয়োগ-বেদনা অসহনীয়। ফলে সন্তানের মৃত্যুতে কোনো কোনো মা-বাবার মুখ থেকে এমন কথা বের হয়ে যায়, যা কুফরি কথা। যেমন সন্তানের মৃত্যুতে কোনো কোনো মা-বাবাকে বলতে শোনা যায়- “আল্লাহ আমার সন্তান ছাড়া আর কাউকে দেখল না।” মুমিন এমন কোন কথা বলতে পারে না। দ্বিনি জ্ঞান, সহিহ দ্বিনি বুঝ ও ভারসাম্যের অভাবেই মানুষ এমন কথা বলে ফেলে। এটি একটি কুফরি বাক্য, যা আল্লাহর ফয়সালার উপর আপত্তি ও অভিযোগের বাক্য। সন্তান আল্লাহর দান। তিনি যাকে ইচ্ছা সন্তান দান করেন। যাকে ইচ্ছা দান করেন না। তেমনি সন্তান দেওয়ার পর সন্তানকে জীবিত রাখা বা নিয়ে যাওয়াও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর এ সন্তান তো আল্লাহই অনুগ্রহ করে দান করেছিলেন, তিনিই আবার নিয়ে গেছেন। তাছাড়া এতে অনেক হেকমতও নিহিত থাকে, যা আমাদের জানা নেই। সুতরাং আল্লাহর ফয়সালা মেনে নেওয়া ও সবর করাই মুমিনের শান ও নবিজির শিক্ষা। নবিজি ﷺ এর কোনো এক কন্যা খবর পাঠালেন- তার এক সন্তান মৃতপ্রায় অবস্থা। তখন নবিজি খবরদাতাকে বললেন, তুমি গিয়ে তাকে বল-
إِنّ لِلهِ مَا أَخَذَ وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمّى، فَمُرْهَا فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ
আল্লাহ যাকে নিয়ে যান সেও আল্লাহর, যাকে রাখেন সেও তাঁর। আর সবকিছুর জন্যই তাঁর কাছে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়সীমা। সুতরাং তুমি তাকে ধৈর্য ধারণ করতে বল এবং সওয়াবের আশা করতে বল। পরে নবিজি ﷺ তাকে দেখতে গেলেন। -সহিহ মুসলিম, হাদিস-৯২৩

কারো মৃত্যুতে মাতম করা, জামা-কাপড় ছেঁড়া, গাল চাপড়ানো, জাহেলি কথাবার্তা বলা- এগুলোর ব্যাপারে হাদিস শরিফে ধমকি এসেছে।

নবিজি ﷺ বলেন-
لَيْسَ مِنّا مَنْ لَطَمَ الخُدُودَ، وَشَقّ الجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الجَاهِلِيّةِ
যে (কারো মৃত্যুশোকে বিলাপ করে) গাল চাপড়ায়, জামা ছেঁড়ে এবং জাহেলি যুগের মত বিভিন্ন (অন্যায়) কথা বলে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। -সহিহ বুখারি, হাদিস-১২৯৪

তাহলে কি সন্তান বা কারো বিয়োগ-বেদনায় কাঁদাও যাবে না? হ্যাঁ, কাঁদা যাবে, তবে বিলাপ করা এবং জাহেলি কথাবার্তা বলা যাবে না। নিজ সন্তানের বিয়োগ-বেদনায় নবিজিও কেঁদেছেন, কিন্তু সাথে সাথে সতর্কও করে দিয়েছেন- এ অবস্থায়ও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কথা বলা যাবে না। নবিজির সন্তান ইবরাহিম রা. এর মৃত্যুর সময় নবিজি কাঁদছিলেন। এ দেখে আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. বললেন, আপনিও কাঁদছেন আল্লাহর রাসূল! (তিনি ধারণা করেছিলেন, এ সাধারণ কান্নাও নিষিদ্ধ বিলাপের অন্তর্ভুক্ত)। তখন নবিজি ﷺ বললেন, (এটি বিলাপ নয়) এ তো মানুষের মনের দয়া-মায়া (এর স্বাভাবিক প্রকাশ ও কষ্টের অশ্রু, এতে সমস্যা নেই)। তারপর বললেন-
إِنّ العَيْنَ تَدْمَعُ، وَالقَلْبَ يَحْزَنُ، وَلاَ نَقُولُ إِلّا مَا يَرْضَى رَبّنَا، وَإِنّا بِفِرَاقِكَ يَا إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ
চোখ অশ্রুসজল, হৃদয় ব্যথিত। কিন্তু আমাদের রব অসন্তুষ্ট হন- আমরা এমন কথা বলব না। হে ইবরাহিম! তোমার বিয়োগে আমরা বড়ই ব্যথিত। -সহিহ বুখারি, হাদিস-১৩০৩

সুতরাং কারো মৃত্যুতেই আমরা বিলাপ করব না এবং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কথা বলব না। বরং ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলব এবং সবর করব, যার বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাত দিবেন।

হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا لِعَبْدِي المُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ، إِذَا قَبَضْتُ صَفِيّهُ مِنْ أَهْلِ الدّنْيَا ثُمّ احْتَسَبَهُ، إِلّا الجَنّةُ
যখন আমি আমার মুমিন বান্দার প্রিয়জনকে উঠিয়ে নিই আর সে (সবর করে এবং) সওয়াবের আশা রাখে; কেবল জান্নাতই হতে পারে এর প্রতিদান। -সহিহ বুখারি, হাদিস-৬৪২৪

৪০ দিন পর্যন্ত আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখা
অনেক এলাকায় প্রচলন আছে, কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন বাড়িতে বা যে ঘরে মারা গিয়েছে সে ঘরে আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখে । এর কারণ হিসেবে বলে থাকে মায়্যেতের রূহ চল্লিশ দিন পর্যন্ত আসা যাওয়া করে সুতরাং চল্লিশদিন পর্যন্ত আগরবাতি জ্বালাতে হবে। এ আমলটি একেবারেই ভিত্তিহীন। যেমন ভিত্তিহীন উপরিউক্ত ধারণা। মৃতের রূহ বাড়িতে আসার বিষয়টি ঠিক নয়। জুমার রাতে বা বিশেষ বিশেষ রাতে মায়্যেতের রূহ বাড়ির দরজায় আসে এ ধরনের কিছু রেওয়ায়াত সমাজে প্রচলিত আছে কিন্তু তা সহিহ নয়। হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হল, প্রতি জুমার রাতে মুমিনদের রূহ তাদের পরিবারের কাছে আসে- এটা কি ঠিক? তিনি উত্তরে বলেন, জুমার রাত ও অন্যান্য সময় মৃতের রূহ রাড়িতে আসা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ের রেওয়ায়াত সহিহ নয়। সুতরাং এ বিশ্বাস রাখা ঠিক নয়। -তালিফাতে রশিদিয়্যাহ, পৃ. ২৩৩।

কুলখানি/চল্লিশা
আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে মৃত্যুর ৩য় দিনে কুলখানি নামে এবং ৪০তম দিনে চল্লিশা নামে যে খানার আয়োজন করা হয়, তা ইসলামসম্মত নয়। তবে হ্যাঁ, মৃত ব্যক্তির ইসালে সওয়াবের নিয়তে দিন-তারিখ নির্দিষ্ট না করে গরিবদের খাওয়ানো বৈধ। কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে প্রথা বানিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে খানার আয়োজন করা হয়, ধনী-গরিব সবাইকে আমন্ত্রণ করে এক বিশাল অনুষ্ঠান করা হয়, সামাজিক কারণে অনেকে অর্থ না থাকলেও এমনটি করতে বাধ্য হয়। এ পদ্ধতি গলদ ও গর্হিত। কুরআন, হাদিস ও সাহাবাদের জীবন থেকে তা প্রমাণিত নয়। কোথাও কোথাও লোক দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক খাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ ধরনের খানা খেতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মহানবি ﷺ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অহংকারীর খাদ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস-৩৭৫৪

মূল কথা হলো, মৃত ব্যক্তির জন্য বছরের যেকোনো দিন যেকোনো ভালো আমল দ্বারা ইসালে সওয়াব করা একটি ভালো কাজ। নগদ টাকা সদকা করা, বিনিময় ছাড়া তিলাওয়াত, তাসবিহ অথবা গরিব-মিসকিনদের খানা খাওয়ানো ইত্যাদির মাধ্যমে যেকোনো সময় ইসালে সওয়াব করা যায়। তবে দিন-তারিখ নির্ধারিত করে, যেমন—তিনদিনা, সাতদিনা, চল্লিশদিনা বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা নব-আবিষ্কৃত কুপ্রথা। এগুলো শরিয়তসম্মত না হওয়ায় অবশ্য বর্জনীয়। -রদ্দুল মুহতার ২/২৪০; ফাতাওয়া ফকিহুল মিল্লাত ১/৪৩৯-৪৪৭।

কবরে খেজুর ডাল পুঁতে দেওয়া
অনেক এলাকায় প্রচলন আছে, মায়্যেতকে দাফন করার পর চার ব্যক্তি কবরের চার কোণে দাঁড়িয়ে চার কুল (অর্থাৎ সূরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস) পড়ে। তারপর তারা কবরের চার কোণে চারটি তাজা ডাল পুঁতে দেয়। কোথাও আবার চার কোণের চারটি খুঁটি হাতে চার কুল পড়ে খুঁটিগুলো গেড়ে দেয়। কোথাও চার খুঁটিতে সুতা পেঁচায়। আবার কেউ বলল, তাদের এলাকায় চারটি কঞ্চি হাতে চার কুল পড়ে কঞ্চি চারটি কবরের উপর রাখে। এটি একটি মনগড়া রসম যার কোনো ভিত্তি নেই। কোনো হাদিস বা সাহাবা-তাবেয়িন থেকে এ আমলের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং তা বর্জনীয়। এ জাতীয় মনগড়া কোনো রসমের পিছে না পড়ে প্রমাণিত কোনো আমল করা উচিত। যেমন দাফন শেষে মায়্যেতের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা এবং কবরের সুওয়াল জওয়াব সহজ হওয়ার জন্য দুআ করা। মায়্যিতের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সুরা বাকারার শুরু থেকে মুফলিহুন (১-৫ আয়াত) পর্যন্ত এবং আমানার রাসুলু থেকে শেষ পর্যন্ত (২৮৫-২৮৬ আয়াত) তিলাওয়াত করে ইসালে সওয়াব করা ইত্যাদি।

কবরে কুরআনের আয়াত, দুআ, কবিতা বা প্রশংসামূলক বাক্য লিখে রাখা
মৃত ব্যক্তির কবরের উপর বা পাশে কুরআনের আয়াত, দুআ, কবিতা বা প্রশংসা-স্তুতিমূলক বাক্য লিখে রাখা নিষেধ। হাদিস শরিফে কবরে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, নবি কারিম ﷺ কবর পাকা করা, তার উপর লেখা, কবরের উপর ঘর নির্মাণ করা এবং তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন। -জামে তিরমিযি, হাদিস-১০৫২ অবশ্য কখনো কবর শনাক্ত করার প্রয়োজন হলে মৃতের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে রাখার অবকাশ আছে। সাহাবি হজরত উসমান বিন মাযউন রা.-এর কবরের পাশে এ উদ্দেশ্যেই নবি কারিম ﷺ পাথর রেখেছিলেন এমন বর্ণনা হাদিস শরিফে এসেছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস-৩১৯৮

এ বর্ণনার আলোকে ফকিহগণ বলেছেন, কবর পরিচয়ের স্বার্থে কবরের পাশে মৃতের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে রাখার অনুমতি রয়েছে। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/৬৫।

কবরের মাটি মহিলাদের নিকট নিয়ে আসা
কোনো কোনো এলাকায় এ রসম রয়েছে যে, দাফনের সময় কবরের মাটি একটি ঝুড়িতে করে বাড়ির মহিলাদের কাছে নিয়ে আসা হয়। মহিলারা দুআ পড়ে ওই মাটি ছুঁয়ে দেয়। তারপর তা কবরে ঢেলে দেওয়া হয়। এটি একটি অমূলক রসম, শরিয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই। সুতরাং তা অবশ্যই বর্জনীয়।

লেখক : ইমাম ও খতিব (অ.দা.), কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!