রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে জাতিসংঘের। ফলে তুলে নিয়ে যেসব স্থানে ভুক্তভোগীদের ‘গোপনে আটকে রাখা হয়’, সেগুলোর তালিকা প্রকাশ করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
আজ সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এ শুনানিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ নিয়ে তৈরি সংস্থাটির প্রতিবেদনে এ তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী আটক অনেক ব্যক্তিকে গোপন স্থানে রেখে নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা অস্বীকার করেছে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংখ্য অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের মতো কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে সংস্থাটির। এ ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ক্ষমতা কমিয়ে আনতে সুপারিশ করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, না জানিয়ে আটকে রাখা, গুম এবং হেফাজতে মৃত্যুর মতো সব অভিযোগ স্বাধীন সংস্থা দিয়ে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তদেন্ত দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। আইনে এমন ধারা যুক্ত করতে বলা হয়েছে, যাতে গুম রোধ করা যায়। এ ছাড়া গোপনে কাউকে আটকে রাখা হয়নি, তা নিশ্চিত করতে বলেছে সংস্থাটি।
নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ নিয়ে মানবাধিকার হাইকমিশনার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং স্বচ্ছ তদন্ত করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার চেয়েছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া গুমের চলমান অভিযোগগুলোও আমলে নিয়েছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রে নিয়ম ও বিচারিক সুরক্ষার ঘাটতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে বিচারকদের ক্রমাগত হুমকি ও চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ অন্যদের হুমকি, নির্যাতন এবং চাপ থেকে বিচারকদের সুরক্ষা দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিচারক ও সরকারি আইনজীবীরা যাতে পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকরা যাতে তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেন, সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
বাংলাদেশে এখনও বেশির ভাগ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। ফলে তাদের সামাজিক ও শ্রম সুরক্ষা নেই। এ ক্ষেত্রে তাদের নিয়মিত শ্রম খাতে যুক্ত করতে সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সব শ্রমিকের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি-সংক্রান্ত কোনো কাঠামো নেই। এ জন্য সবার জন্য জাতীয় সর্বনিম্ন মজুরি কাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। আর বিদ্যমান সর্বনিম্ন মজুরি এমন পর্যায়ে নিতে সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারেন। শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে বলা হয়েছে। নারীর কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি ও সামাজিক বাধা দূর করতে বলা হয়েছে। বর্তমান শ্রম আইন সংস্কার নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আইনে দুর্বলতা দেখতে পেয়েছে সংস্থাটি। বিশেষ করে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে বৈষম্য বিদ্যমান। আইনে এ বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। ফলে জাতিসংঘ থেকে আইনটিকে পর্যালোচনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে জাতিসংঘের। জাতিসংঘ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। এ ক্ষেত্রে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে মৃতুদণ্ড এড়াতে পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
ইউপিআরে অংশ নিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বর্তমানে জেনেভায় অবস্থান করছেন। প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। শুনানিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা এবং এ সম্পর্কে উত্থাপিতব্য বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেবে প্রতিনিধি দলটি।
মূলত তিনটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমত, সরকারের দেওয়া জাতীয় প্রতিবেদন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের মূল্যায়ন। এ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয়ের প্রতিবেদন এ শুনানিতে আমলে নেওয়া হয়।
চার বছর পরপর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনায় বিভিন্ন সদস্য দেশ পর্যালোচনাধীন রাষ্ট্রকে মানবাধিকার-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে প্রশ্ন ও সুপারিশ করে।
২০১৮ সালের ১৪ মে সর্বশেষ ইউপিআরে ২৫১টির মধ্যে ১৭৮টি সুপারিশকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। অবশিষ্ট ৭৩টি সুপারিশের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্যসংবলিত ‘নোট’ দিয়েছে সরকার। ইউপিআরে সেটি ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় অংশগ্রহণ। তৃতীয় শুনানিতে বাংলাদেশের গ্রহণ করা সুপারিশের মধ্যে ২৫টি ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা সম্পর্কিত।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রথমবারের মতো ইউপিআরে অংশগ্রহণ করে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয় শুনানি হয়।