নির্বাচনের মাঠ থেকে একে একে সরে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ২৬ আসনের বাইরে থাকা জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীরা। দুই শতাধিক আসনে দলটির প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে নেই। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে ১৩ আসনে ঘোষণা দিয়ে সরে গেছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর খোঁজ পাচ্ছেন না। নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে খবর নিচ্ছে না দল। নির্বাচন খরচসহ যেসব সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল, তা দিচ্ছে না।
প্রার্থীদের ভাষ্য, দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত দিলেও ‘বিশেষ জায়গা থেকে তহবিল’ পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাপা। ‘বি ক্যাটেগরি’ আসনের প্রত্যেক প্রার্থীকে ৩০ লাখ এবং ‘সি ক্যাটেগরি’ আসনের প্রার্থীদের ২০ লাখ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু শীর্ষ নেতারা ওই টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন।
তবে জাপা সূত্রের খবর, সেই টাকা পাওয়া যায়নি। সে কারণেই প্রার্থীদের সহায়তা করা যাচ্ছে না।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৮৭ আসনে জাপা ৩০৪ প্রার্থী দেয়। আপিলের পর ২৮৩ আসনে প্রার্থিতা বৈধ হয়। প্রতীক বরাদ্দের আগের দিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার হয় ১৮ আসনে। শেষ পর্যন্ত ২৬৫ আসনে থাকে লাঙ্গল। তবে গতকাল পর্যন্ত ১৩টি আসনের ১১ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ায় ব্যালটে নাম থাকবে তাদের।
দিনাজপুর-২ আসনের মাহবুব আলম, সিরাজগঞ্জ-৩ জাকির হোসেন, চুয়াডাঙ্গা-১ অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন, গাজীপুর-১ ও ৫ এম এম নিয়াজ উদ্দিন, গাজীপুর-৪ মো. সামসুদ্দিন খান, বরিশাল-২ ও ৫ ইকবাল হোসেন তাপস, বরগুনা-১ মো. খলিলুর রহমান, সুনামগঞ্জ-১ আবদুল মান্নান তালুকদার, হবিগঞ্জ-২ শংকর পাল, হবিগঞ্জ-৪ আহাদউদ্দিন চৌধুরী শাহীন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ এর মোহাম্মদ শাহানুল করিম নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে ইকরামুজ্জামানকে সমর্থন করে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন শাহানুল করিম। বাকি ১২ প্রার্থীর অভিযোগ, দল ও নির্বাচনের পরিবেশ তাদের বিরুদ্ধে।
নির্বাচন পরিচালনায় গত ২১ ডিসেম্বর মুজিবুল হক চুন্নুকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করে জাপা। এখন পর্যন্ত কমিটি একজন প্রার্থীকেও নির্বাচনী সহায়তা দেয়নি। কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘আর্থিকসহ নানা সহযোগিতা চেয়ে প্রার্থীরা যোগাযোগ করছেন। তবে কাউকে আর্থিক সহায়তা করা সম্ভব হয়নি।’
সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার কড়া সমালোচক ছিলেন জি এম কাদের। অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন বর্জনের হুঁশিয়ারিও দেন। একটি সূত্রের খবর, নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার শর্ত ছিল, সম্মানজনক সংখ্যক আসন ছেড়ে দিয়ে আগামী সংসদেও বিরোধী দল বানাতে হবে। রওশন এরশাদ নন, জি এম কাদের হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। শর্ত পূরণের আশ্বাসে ভোটে অংশ নেয় জাপা। বিএনপিবিহীন ৭ জানুয়ারির ভোটে ৫০ আসনে ছাড় চেয়েছিল দলটি। আওয়ামী লীগ দিয়েছে ২৬টি। জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য ঢাকা-১৮ আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহারের পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয় জাপা।
গত নভেম্বর থেকে অনেকটা নীরব জি এম কাদের। রংপুর-৩ আসনে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সেখানে গত সোমবার তিনি বলেন, ‘অনেক সময় অনেক প্রার্থী নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকে না। কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, আবার কেউ এমনিতেই চলে যান। যারা নির্বাচন করতে চান না, সেটা তাদের অধিকার। এটা হুমকির কারণেও হতে পারে, অর্থের অভাবেও হতে পারে। অনেক প্রার্থী অর্থশালী নন। ফলে অর্থের কারণেও অনেকে নির্বাচন থেকে সরে যান।’
জাপা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা, তা সময় বলবে বলে জানান দলটির চেয়ারম্যান। গত বৃহস্পতিবার রংপুর যাওয়ার আগে তিনি ঢাকায় প্রতিবেশী একটি দেশের দূতাবাসে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোহরাব হোসেন বলেন, ‘টাকার পাল্লা দেওয়ার অবস্থা আমার নেই। এ ছাড়া দলের চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, ফোন দিলেও ধরেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও নির্বাচনী কমিটির কেউ সহযোগিতা করছেন না। সরকারের কাছ থেকে ২৬ আসন নিয়েছেন নেতারা। আমাদের সব দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’
গাজীপুর-৪ আসনের সামসুদ্দিন খান জানান, শারীরিক, পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের আবদুল মান্নান তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাচ্ছি না, সহযোগিতা পাচ্ছি না। এতে মনে হচ্ছে আসন ভাগাভাগির নির্বাচন হচ্ছে। তাই সরে দাঁড়ালাম।’
হবিগঞ্জ-২ আসনের শংকর পাল বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী পরিচয়ে পোস্টার ছাপানোর লোক নই। তাহলে আর জাতীয় পার্টি থাকল কই? আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়া যাবে না।’
তবে জাপার একাধিক প্রার্থী জানান, তাদের বলা হয়েছিল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সরকার প্রার্থী বাড়াতে চায়। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে জাপার প্রার্থীদের ভোট করার খরচ দেওয়া হবে। যেসব আসনে জাপার মোটামুটি অবস্থান আছে, সেখান ৩০ লাখ করে এবং যেখানে অবস্থান দুর্বল সেখানে ২০ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। এ কারণেই জয়ের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই- এমন আসনেও জাপা নেতারা আগ্রহ নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু প্রার্থী হওয়ার পর কানাকড়ি মিলছে না। উল্টো কয়েক লাখ টাকা করে নিজের পকেট থেকে খরচ হয়েছে। জাপার কারও কারও আশা ছিল, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পেয়ে এমপি হবেন। তা না হওয়ায় অনেকে সরে যাচ্ছেন নির্বাচন থেকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং মহানগর উত্তর জাপার সভাপতি শফিকুল ইসলাম ঢাকা-১৩ ও ১৪ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তিনি বলেন, ‘২৬ জন ছাড় পেয়ে এমপি হবেন আর বাকিরা জয়ের আশা না থাকলেও টাকা খরচ করবেন, এভাবে নির্বাচন হয় না। জি এম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু এবং দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন।’
আসন ছাড় না পাওয়ায় জয়ের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে মনে করায় জাপার অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে নীরবে সরে গেছেন। আর যেসব আসনে জাপার ভোট নেই, সেখানেও প্রার্থীরা প্রচারে নেই। সমঝোতার ২৬ আসনের বাইরে লালমনিরহাট-৩, রংপুর-২, গাইবান্ধা-৪, ঢাকা-১, ঢাকা-৪, নারায়ণগঞ্জ-৩, বরিশাল-৬, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে আরও ১০-১২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকলেও প্রচারে আছে লাঙ্গল।
সমঝোতার ২৬ আসনে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও কয়েকটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হারতে পারে লাঙ্গল। এসব আসনের প্রার্থীরা সহায়তা চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন জহিরুল ইসলাম জহির। তবে তারাও সহায়তা পাননি।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেছেন, ‘জি এম কাদের নানামুখী চাপে রয়েছেন। প্রার্থীরা নির্বাচন করতে গিয়ে নানা চাপে পড়ছেন। সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, একটিও রাখেনি। ফলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন করতে অনেক খরচ ও আনুষঙ্গিক বিষয় আছে। এসব চাপ চেয়ারম্যান নিতে পারছেন না, ফলে তিনি বিরক্ত।