খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৩৪
  যাত্রাবাড়িতে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ২৪ বছর পার, খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণে গতি আসেনি

বিশেষ প্রতিনিধি

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন- জমি অধিগ্রহণের দুই যুগ পরও খুলনার খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মানে গতি আসেনি। এমনকি জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরনের টাকা অনেকেই পাইনি বলে অভিযোগ। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে সুন্দরবনের নিকটবর্তী এবং পদ্মা সেতু হওয়া এই বিমান বন্দর না করার পক্ষে সুপারিশ আছে। তবে রামপাল-মংলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খুলনার সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, পিপিপি’তে নয়, রাজম্ব খাতের নিজম্ব অর্থায়নে এই বিমানবন্দর নির্মাণ করার জন্য সুপারিশ করেছেন।

বিভাগীয় শহর খুলনায় বিমান বন্দর নির্মাণের বিষয়টি আলোচনা সেই ষাটের দশক হতে । তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে খুলনার মূল শহর হতে ১৭ কিলোমিটার দূরে ফুলতলার মশিয়ালীতে বিমান বন্দর নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯৬৮ সালে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে খুলনা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দুরে বিল ডাকাতিয়ার তেলিগাতিতে স্থান নির্বাচন এবং জমি অধিগ্রহণও হয়। পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে আশির দশকে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালিতে স্থান নির্ধারণ করা হয়। এরশাদ সরকারের আমলে তৎকালিন বিমান মন্ত্রী মরহুম কর্নেল এইচ এম গাফফার খুলনা-মংলা সড়কের উপর ষ্টল বিমান নামানোর ঘোষণা দেন। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ৯৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া বাগেরহাট জেলার রামপালে খানজাহান আলী বিমানবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে স্টলপোর্ট চালুর জন্য মাটি ভরাটসহ নানাবিধ কাজও সম্পন্ন হয়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনায় খানজাহান আলী বিমান বন্দরকে পুর্ণাঙ্গ বিমান বন্দরে রূপ দেয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর নতুন করে আরো ৫৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ৫৪৪ কোটি টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা হয় । প্রকল্পে দেশী ও বিদেশী যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সীমানা চিহ্নিত করণে কাটাতারের বেড়া আর একটি সাইন বোর্ড ছাড়া কিছুই হয়নি। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি বলে তাদের দাবি ।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার হোগলডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মামুন মলঙ্গীর স্ত্রী মারিয়া বেগম (৩০) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার বসতবাড়ির জমিটুকু ছাড়া আর কোন জমি নেই। জমিটুকু বিমানবন্দরের জন্য সরকার নিয়ে নিয়েছে। টাকা যা পেয়েছি তাতে নতুন করে জমি কিনতে পারছি না। নতুন জমির অনেক দাম। আবার বসত বাড়ি করার মত জমি কিনতেও পাওয়া যায় না। দীর্ঘকাল যাবত একসঙ্গে প্রতিবেশিদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করছি। নতুন বাড়ি-ঘর তৈরী করে যেখানে যাব সেখানকার সবাই অপরিচিত। স্বজনদের ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে। নতুন শুরুর জন্যে প্রয়োজন অনেক। কিন্তু সরকার আমাদের প্রয়োজনের দিক দেখছে না। আমাদের বসবাসের সুযোগ যদি না হয় তবে আমরা এই টাকা দিয়ে কি করবো? অভাবের সংসারে নগদ টাকা কয়েকদিনের মধ্যে খরচ হয়ে যাবে, তারপরতো একেবারে পথে দাঁড়াতে হবে।”

শুধুমাত্র মারিয়া বেগম নন, হোগলডাঙ্গা গ্রামের প্রায় সকল পরিবারের সদস্যদেরই কণ্ঠে এমন হাহাকার। খানজাহান আলী বিমানবন্দরের জন্যে নতুনভাবে জমি অধিগ্রহণের জন্যে এই গ্রামের প্রায় সকল জমিই চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের টাকা নেওয়ার জন্যে অফিস আদেশ হয়েছে। জমি, অবকাঠামো ও অন্যান্য ফসলের জন্যে ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। বিপত্তি হয়েছে ক্ষতিপূরণের অর্থ সকলের এক রকম হয়নি। কারও কারও অভিযোগ, ভূমি অফিসের কর্তারা সুবিধা নিয়ে কাউকে কাউকে অনেক ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিয়েছে; আর যারা তাদেরকে সন্তুষ্ট করেনি, তাদের জন্যে ক্ষতিপূরণের অর্থ খুবই কম নির্ধারিত হয়েছে।

একই গ্রামের মনসুর মল্লিক জানান, তিনি ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। এর জন্যে অফিসে দিতে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। মাহমুদ মৌলঙ্গীকে ক্ষতিপূরণের ২৪ হাজার টাকা নিতে দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা। মাহমুদ মৌলঙ্গী বসতঘরের ক্ষতিপূরণ পাননি, পেয়েছেন মুরগীর ঘর বাবদ ২৪ হাজার টাকা।

রামপাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সাধন কুমার বিশ্বাস জানান, খানজাহান আলী বিমান বন্দরের জমি অধিগ্রহণ করা ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকরা অনেকেই টাকা এখন পাননি। তিনি আরো জানান, বিমান বন্দর নির্মাণে আগ্রগতি বলে কিছু তার জানা নাই। বলেন, দৃশ্যমান বলতে সীমানা প্রাচীর দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি সিভিল এভিয়েশন দেখছে তারাই ভালো বলতে পারবে। স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছেন দীর্ঘদিনই বিমান বন্দরের নির্মান চিত্র একই।

খুলনা-মংলা মহাসড়কের পাশে যেভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রেখে দ্রুত বিমান বন্দরের কাজ শুরু এবং শেষ করার দাবি জানান বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স সভাপতি মোঃ লিয়াকত হোসেন। তিনি দাবি করেন, মংলা বন্দর গতিশীল করতে বিমানবন্দর খুবই জরুরী।

যশোরের নওয়াপাড়া হতে বাগেরহাটের মংলা পর্যন্ত খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর এলাকাভুক্ত হলেও তাদের কোন বিমান বন্দরের পরিকল্পনা নাই বলে জানান প্রধান প্রকৌশলী সাবিরুল ইসলাম। ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার কেডিএর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন পর্ষালোচনা বৈঠকে বিমান বন্দর প্রসঙ্গে জানানো হয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এর নগর পরিকল্পনাবিদদের সুপারিশ রয়েছে খানজাহান আলী বিমান বন্দর ষ্টল বিমান বন্দর করা যাবে, কিন্তু বড় পরিসরে বিমান বন্দর তেমন লাভজনক হবে না।

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জড়িত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর এবং গ্রামীন পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের সাবেক ডীন প্রফেসর ড. রেজাউল করিম জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলে খানজাহান আলী বিমান বন্দরের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। একই ভাবে সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ায় বিমান বন্দরের শব্দ জীব জন্তুর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এজন্য তারা বিমান বন্দর নির্মাণে নিরুৎসাহিত করছেন। তিনি সম্প্রতি খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রণয়ন করা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা টিমের সদস্য ছিলেন। তিনি জানান, কেডিএ’র পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় পদ্মা সেতু নির্মাণের কারনে খানজাহান আলী বিমান বন্দর বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে না বলে জানান। বলেন, খুলনা থেকে খানজাহান আলী বিমান বন্দর থেকে বিমানে ঢাকা পৌঁছাতে যে সময় লাগবে সেই একই সময় সড়ক পথে পদ্ম সেতু পার হয়ে যাওয়া যাবে। একই ভাবে খুলনা-মাওয়া –ঢাকা হাইওয়ে সড়ক অনেক আরমদায়ক চলাচল ।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার ফয়লায় খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনায় ছিল। মূল প্রকল্পটি সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালের মে মাসে একনেকে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে প্রকল্পটি পিপিপি’র আওতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে গ্রহণের জন্য নীতিগত অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

তবে রামপাল-মংলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, র্দীর্ঘদিন প্রকল্পটি পিপিপি’তে থাকায় কোন অগ্রগতি নাই। তাই এবার রাজস্ব খাতে নিজস্ব অর্থায়নে বিমানবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেছেন তিনি। তিনি স্বীকার করেন, পিপিপিতে থাকায় বেসকারীভাবে কেউ এগিয়ে না আসায় দীর্ঘদিন বিমানবন্দর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি নাই। তবে তিনি পিপিপি হতে বাদ দিয়ে এই প্রকল্প রাজস্ব খাতে এনে নির্মাণ করার সুপারিশ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মংলা বন্দর এলাকা যে ভাবে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে তাতে বিমান বন্দর জরুরী হয়ে পড়েছে। তিনি স্বীকার করেন দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দর নির্মাণ কাজ ধীর গতিতে চলছে। বলেন, ১৯৯৬ সালে ষ্টল বিমান বন্দর নির্মাণের জন্য ৯৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরে কাজ সম্প্রসারণ করতে আরো ৫৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। রাজম্ব খাতেই এবার দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

 

খুলনা গেজেট / এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!