এক সময় যার নামে শুনে যে কেউ আৎকে উঠতো। শরীরের ভয়ের অনুভূতি তৈরী হতো, সে ইতিহাস অনেকটাই পুরনো। কিন্তু এই মানুষটিকে ঘিরে রহস্য যেন শেষ হয়না। এখনো বিচিত্র কথা ভেসে বেড়ায়। তাঁর নাম এরশাদ শিকদার ওরফে রাঙ্গা চোরা, আজ ইতিহাস। ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাঁর নিজের হাতে নির্মিত খুলনা মহানগরীর মজিদ সরণীর সুরম্য ‘স্বর্ণকমল’ ঘিরে ছিল নানা রহস্য। প্রায় দু’দশক পরও দূর-দুরান্ত সেখানে ছুটে আসতো মানুষ। এটি ছিল এরশাদ শিকদারের বাসভবন। এই ভবণ নির্মাণ, স্থাপত্যশৈলী , ভবন অভ্যন্তরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও ছিল অম্লমধুর আলোচনা। এবার হয়তো সেই অধ্যায়ের যবনিকা ঘটবে। ভাঙা পড়ছে রহস্য ঘেরা স্বর্ণকমল।
স্বর্ণকমল নিয়ে যত কথা : খুলনার সোনাডাঙ্গার মজিদ স্মরণিতে দাঁড়িয়ে ছিল এরশাদ শিকদারের বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল।’ এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী এই ‘স্বর্ণকমল।’ বাড়িটিতে গোপন কুঠরি এবং অস্ত্র ভা-ারের কথাও শোনা যায়। শোনা যায়, ওই বাড়িটির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসত বাড়িটিতে। শহরের নামীদামী ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এক সময় সাধারণ মানুষের খুব আগ্রহের একটি জায়গা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসত। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই বাড়িটি। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করার পর জৌলুশ হারানো বাড়িটি ছিল রহস্যে ঘেরা।
কথিত আছে, বাড়িটি বানানোর সময় এরশাদ শিকদারের হাতে খুন হন নির্মাতা। বাড়ি নির্মাণের গোপন বিষয়গুলো যাতে কেউ জানতে না পারে এ জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, এ বাড়িটি নির্মাণের সময় কিছু অংশ অন্যের জমিতে ঢুকে যাওয়ায় নির্মাতাকে খুন করে এরশাদ শিকদার। এরশাদ শিকদার যখন জীবিত ছিলেন তখন অবৈধ উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করেছিলেন। বাড়িটিতে বসতো জলসা। এখানে সমবেত হতে অনেক রথি-মহারথিরা।
বাড়ির সামনে নামফলকটিও খুলে ফেলা হয়েছিল অনেক দিন আগে। ১৮ বছর আগের সেই জৌলুশ না থাকলেও এখন মানুষ ভবনটি দেখতে আসতো। কিন্তু সম্প্রতি ভবনের একাংশ ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরশাদ শিকদারের ছেলেরা। সেই সিদ্ধান্তের পর বাড়িটির ভিতরে ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়।
কর্মরত শ্রমিক আজিজুল, রহমানসহ অন্যরা জানান, স্বর্ণ কমলের অর্ধেক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। জমির মালিকরা সেখানে বহুতল ভবন করবেন। এ কারণেই গত কয়েকদিন ধরে ভাঙ্গার কাজ চলছে।
স্থানীয়রা বলেন, ‘স্বর্ণকমল’ বাড়িটি খুলনার আলোচিত। পুরাতন হলেও মজবুত। বাইরে থেকে বাড়িটি খুব সুন্দর লাগতো। এরশাদ শিকদারের বাড়িকে ঘিরে মানুষের অনেক কৌতুহল। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই বাড়িটি দেখতে আসতো। হঠাৎ করেই দেখছি বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে। শুনেছি বাড়িটি ভেঙে ১০ তলা ভবন করা হবে। বাড়িটি ভেঙে ফেলায় খারাপ লাগছে।
এরশাদ শিকদারের মঝো ছেলে কামাল শিকদার জানান, কেডিএ’র ১০ কাঠা জমির ওপর তাদের একটি পুরাতন তিনতলা এবং আরেকটি দুইতলা বাড়ি ছিল। তারা কয়েকদিন আগে পুরাতন তিনতলা ভবনটি শ্রমিক দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। এখন দুইতলা ভবনটির অর্ধেকের মতো অংশ ভাঙা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা ৫ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এরশাদ শিকদার ও অভিযোগ : এরশাদ শিকদার কর্মকা- প্রকাশ হতে থাকলে তিনি সিরিয়াল কিলারের হিসেবে পরিচিতি পান। প্রায় ৬০ টিরও বেশী খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পর দুধ দিয়ে গোসল করতেন তিনি ও তার সহযোগীরা। অসংখ্য নারী ধর্ষণ, একাধিক বিয়েসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এরশাদ শিকদার তার জীবদ্দশায় করেননি।
তিনি সদম্ভে বলতেন, পৃথিবীর কেউই তাকে তার আসন থেকে সরাতে পারবে না। তাঁর কণ্ঠে ‘আমি তো মরেই যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবি/ আছসনি কেউ সঙ্গের সাথী, সঙ্গেনী কেউ যাবি/ আমি মরে যাবো’- গানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী শিকদার। ৮ ভাই বোনের মধ্যে এরশাদ শিকদার ছিল দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সালে জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে যান এরশাদ শিকদার। কিছুদিন পর রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করতো এমন দলে যোগ দেন।
পরে তাদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন এবং এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পান শিকদার। মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে এরশাদ শিকদার রামদা বাহিনী নামে একটি দল গঠন করেন। যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। এই রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ শিকদার ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।
১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময় এরশাদ শিকদার ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর আরও ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হন। ৬০টিরও বেশি হত্যাকা-ে জড়িত ছিলেন এরশাদ শিকদার। ২৪টি হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন তার বডিগার্ড নুর আলম। ২০০৪ সালের ১০মে মধ্যরাতে খুলনার জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
এরশাদ শিকদার নিয়ন্ত্রিত ঘাট এলাকাগুলোতে এখন আর তার কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। নিজ নামে প্রাইমারী স্কুলটি রয়েছে। বরফকলের মালিকানা বদলেছে। দখলকৃত অনেক জায়গা উদ্ধার করেছে রেলওয়ে। বেশ কিছু জায়গা চলে গেছে নতুন প্রভাবশালীদের দখলে। জীবিত থাকতে তার এলাকায় তিনি ছিলেন ত্রাস। এখন তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন খুলনার টুটপাড়া কবরস্থানে।
কোথায় আছেন পরিবারের সদস্যরা : এরশাদের দুই স্ত্রী খোদেজা বেগম ও সানজিদা নাহার শোভা। এরশাদ শিকদারের তিন ছেলে রয়েছে। তারা হলেন- মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, কামাল শিকদার ও হেলাল শিকদার। তারা পেশায় ব্যবসায়ী। এছাড়া সুবর্না ইয়াসমিন স্বাদ ও জান্নাতুল নওরিন এশা নামে এরশাদ শিকদারের দুই মেয়ে ছিল। যার মধ্যে এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করেন।
খুলনা গেজেট/কেডি