স্কুলশিক্ষক গোলাম মোস্তফার ঘর আলো করে আসে তিন সন্তান। কয়েক মিনিট ব্যবধানে জন্ম নেওয়া তিন ভাই আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়ায় মা আর্জিনা বেগমের সংসারের। কিন্তু এই সুখানুভূতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৫ বছরের মাথায় স্বামীকে হারান আর্জিনা। তবে ভেঙে পড়েননি তিনি। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করার সংকল্প নিয়ে চালিয়ে যান জীবনযুদ্ধ। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে তিন ছেলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সন্তানদের এমন সাফল্য আনন্দাশ্রুতে ভাসিয়েছে আর্জিনা বেগমকে।
এই ঘটনা বগুড়ার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ি এলাকার। মেডিকেলে সুযোগ পাওয়া তিন ভাই হলেন- মাফিউল হাসান, সাফিউল হাসান এবং রাফিউল হাসান। ধুনট নবির উদ্দিন পাইলট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তারা। এর পর একসঙ্গে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় আসেন। তবে প্রথমবার সাফল্য পান মাফিউল। তিনি ভর্তি হন ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। চলতি বছর সাফিউল দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ও রাফিউল নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছেন।
মাফিউল হাসান বলেন, ‘তিন ভাই বগুড়ায় মেসে একই সঙ্গে থেকে সরকারি শাহ সুলতান কলেজে পড়েছি। মা কষ্ট করে এবং জমি বিক্রি করে পড়ালেখা করিয়েছে। কখনোই আমাদের কষ্ট করতে দেয়নি।’
শাফিউল হাসান বলেন, ‘আজ বাবা থাকলে অনেক খুশি হত। বাবাকে হারিয়েছি শিশুকালে। এখন মাই বাবার অভাব পূরণ করছে। মানুষের সেবা করার জন্য যাতে চিকিৎসক হতে পারি এই দোয়া চাই সবার কাছে।’
রাফিউল ইসলাম বলেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় বাবা মারা যান। যখন বুঝতে পারলাম বাবার সেই কথা তখন থেকেই তিন ভাই প্রতিজ্ঞা করি ডাক্তারি পড়ব। মানবতার তাগিদে গরিব মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা করব। এই গ্রাম থেকে কেউ আগে মেডিকেল চান্স পায়নি। আমরা এক পরিবার থেকে তিনজন মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। এটা একদম অবিশ্বাস্য।’
মা আর্জিনা বেগম বলেন, ‘২০০৪ সালে তিন ছেলের জন্ম। ২০০৯ সালে ওদের বাবা হৃদরোগের মারা যান। তখন ওদের বয়স পাঁচ বছর। বাবার স্নেহ-মমতা পায়নি ওরা। তিনি মারা যাওয়ার পর তিন সন্তানকে পড়ালেখা করানো নিয়ে বিপাকে পড়ি। নিজে কষ্ট করে এবং জমি বিক্রি করে ওদের পড়ালেখা করিয়েছি। প্রায় পাঁচ বিঘা জমি ছিল। বাবার বাড়ির জমিও বিক্রি করেছি ওদের পড়াশোনার খরচের জন্য। বাকি যা আছে তাও প্রয়োজনে বিক্রি করব। তবুও ওদের চিকিৎসক বানাব। যাতে আমাদের মত গরিব মানুষদের সেবা করতে পারে।’
তাদের এই সাফল্য ছুঁয়ে গেছে স্থানীয়দের। তিনভাইকে নিয়ে এখন গর্বের শেষ নেই তাদের শিক্ষকদের। কান্না জড়িত কণ্ঠে শিক্ষক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এরা তিন ভাই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। আমি চাইব তারা যেন দেশ ও দশের কল্যাণে দাঁড়াতে পারে এই দোয়া করি।’
নায়েব আলী নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘তিন ভাইয়ের এক সঙ্গে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আমাদের গ্রামের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা অনেক খুশি হয়েছি। আমরা চাইব তারা যেন ডাক্তার হয়ে গরীব দুঃখীদের পাশে দাঁড়ায়।’