খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১০ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ৪ দিনের সফরে লন্ডনে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ভরা মৌসুমে চালবাজির ১৩ কারণ

গেজেট ডেস্ক

ভরা মৌসুমে যেখানে চালের বাজারে সুবাতাস বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো ছুটেছে দামের ঘোড়া। গেল এক সপ্তাহে মোটা, মাঝারি ও সরু– সব জাতের চালের দর বাড়বাড়ন্ত। চালের দর চড়ার পেছনে মিলারদের দায়ী করছেন পাইকারি বিক্রেতারা। আর মিল মালিকরা দুষছেন ধানের দর বেড়ে যাওয়া এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের বেশি লাভের লোভকে।

চালের দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে মাঠে নামে একাধিক সরকারি সংস্থা। এরই মধ্যে পাইকারি ধান বিক্রেতা, মিলার ও চাল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে সংস্থাগুলো। দাম বাড়ার পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে– এমন ১৩ কারণ চিহ্নিত করা হয়।

হঠাৎ চালের বাজার চড়ার পেছনে নানা বিষয়কে দায়ী করছেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে ধানের অসাধু মজুতদার ও অটো রাইস মালিকদের বেশি মজুত রাখার প্রবণতা, পাল্লাপাল্লি দিয়ে মিলারের ধান মিলারদের কিনে নেওয়া, জ্বালানি তেলের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, তীব্র শীতে মিলগুলোতে শ্রমিক সংকট, স্থানীয় বাজারে সব ধরনের ধানের দাম বেড়ে যাওয়া, পরিবহনের সময় পথে পথে চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করা হয়।

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের একটি সংস্থার তরফ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত চালের বাজার তদারকি, জেলার বাজার পর্যায়ে তদারকি বিস্তৃত করা, অবৈধ ধান ও চালের মজুতদারদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান, অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, কৃষকদের কাছে যাতে সরকারি প্রণোদনা পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করা এবং চালের দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, চাল উৎপাদনের সঙ্গে ছোট-বড় যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের ওপর নজরদারি রয়েছে। শুধু সিরাজগঞ্জের ১৯৪ চাল উৎপাদনকারী মিলারের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এভাবে বেশ কয়েকটি জেলার মিলার, অবৈধ মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতার ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

চাল নিয়ে চালবাজি

আরব আলী ফকির পাবনার ঈশ্বরদীর ফকির অটো রাইস মিলের মালিক। মাসে গড়ে তাঁর মিলে ৮৫০ টন চাল উৎপাদন হয়।  বুধবার তিনি প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিআর৩৯ চাল পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন ২ হাজার ৪০০ টাকায়। এ হিসাবে প্রতি কেজি চালের দাম পড়েছে ৪৮ টাকা। তাঁর ভাষ্য, পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতি মণ বিআর৩৯ ধান তিনি কিনেছেন ১ হাজার ৩০০ টাকা দরে। মাসখানেক আগেও প্রতি মণ ধানের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২১০ টাকা। এক মাসের মধ্যে মণপ্রতি ধানের দর বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা।

আলী ফকির বলেন, পাইকারি কারবারিরা হঠাৎ ধানের বাজার অস্থির করেছেন। এর প্রভাব পড়েছে ভোক্তা পর্যায়েও। কৃষকের হাত থেকে ধান পাইকারদের হাতে আসার পর ধাপে ধাপে দাম বাড়ছে। মিলাররা প্রতি বস্তায় ১৫-২০ টাকা লাভে চাল বাজারে বিক্রি করলেও পরবর্তী সময়ে দুটি ধাপে মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন। একটি ধাপ হলো, পাইকারি ব্যবসায়ী; যারা মিলারদের কাছ থেকে চাল কেনেন। আরেকটি হলো, খুচরা বিক্রেতা। এ দুই হাতে প্রতি কেজি চালে ৬-১০ টাকা লাভ করা হয়। পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বাদ দিলেও ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম আরও কম হওয়ার কথা। গেল এক সপ্তাহে চালের মানভেদে দাম কেজিতে ৩ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

দরদাম কেমন

ঢাকার মিরপুরের পাইকারি চাল বিক্রয় প্রতিষ্ঠান জামালপুর অটো রাইস মিল। ওই প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতা মো. আলী জানান, মাসখানেক আগে মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেটের বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি করতেন ৩ হাজার ২০০ টাকায়। এখন একই চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ৬ টাকা। বিআর২৮ চাল (নতুন) প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা। এই চাল (পুরোনো) বস্তাপ্রতি দাম ২ হাজার ৭০০ টাকা। বস্তাপ্রতি ব্র্যান্ডের চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। মানভেদে গতকাল নাজিরশাইল ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি করছেন ১ হাজার ৫৫০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা।

বগুড়ার কাহালুর মোফাজ্জল অটো রাইস মিলের কর্ণধার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, কয়েক দিন ধরে ধানের দাম প্রতি মণে ১৫০-২০০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিল মালিকরা প্রতি কেজি চালের দাম ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা বাড়িয়েছেন। প্রতি মণ স্বর্ণা ধান প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চাল উৎপাদন করে পাইকার ও ডিলারদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে মণপ্রতি ১১০ টাকা খরচ হয়। প্রতি কেজি ধানে তুষ, গুঁড়া ও খুদ বিক্রয় বাবদ ৭ টাকা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মোটা স্বর্ণা চাল উৎপাদন করতে ৪৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪৯ টাকা খরচ লাগে। প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভে মিলাররা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে চাল বিক্রি করেন। একজন খুচরা বিক্রেতা প্রতি কেজি চাল ৬৫-৬৬ টাকা ধরে বিক্রি করছেন। অসাধু মজুতদার, সিন্ডিকেট সদস্য ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করছেন।

শেরপুরের লোকনাথ রাইস মিলের কর্ণধার গোপাল চন্দ্র সাহা জানান, গতকাল বিআর২৮-এর প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চাল বিক্রি করেছেন আড়াই হাজার টাকায়। মাসখানেক আগে বস্তাপ্রতি ৫০-১০০ টাকা দাম কম ছিল। নাজিরশাইল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মানভেদে দর ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা। তিনি জানান, চার-পাঁচ দিন আগে প্রতি মণ ধান কিনেছেন ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৩৬০ টাকায়। মাসখানেক আগে প্রতি মণ ধানের দর ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা। তিন মাস আগে যখন ধান ভেজা ছিল, তখন মণপ্রতি দাম ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা। দাম বেড়ে যাওয়ায় দু’দিন আগে থেকে ধান কিনছেন না। মানভেদে এক মণ ধান থেকে ২৫-২৬ কেজি চাল হয়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী থেকে ২০ টন চাল ঢাকায় পৌঁছাতে ট্রাকপ্রতি ১৫-১৮ হাজার টাকা পরিবহন খরচ হচ্ছে। এর সঙ্গে টোল, চাঁদাসহ ট্রাকপ্রতি আরও তিন হাজার টাকা গুনতে হয়।

শেরপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, দেশে ৩০-৪০ ধরনের ধান রয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাজারে গিয়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল কেনেন। হাইব্রিড ধান কেটে ভোক্তাকে ফাঁকি দিতে এ ধরনের চাল বাজারজাত করা হচ্ছে। চালের দাম কিছুটা বাড়ার পেছনে মিলার, মধ্যস্বত্বভোগী ও প্যাকেটজাত করে যারা বাজারে বিক্রি করছেন, তাদের কারসাজি রয়েছে। ধানের দাম বাড়ালে কিছুটা হলেও কৃষক লাভবান হয়। চালের দাম বাড়লে কৃষকের কোনো লাভ নেই।

বাজারে অভিযান

গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও নিউমার্কেটে চালের বাজারে অভিযান চালায় খাদ্য অধিদপ্তর। অভিযানে ব্যবসায়ীদের ফুড গ্রেইন লাইসেন্স নবায়ন ও চালের দর না বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করা হয়।

এদিকে, নওগাঁয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত রাখার অপরাধে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার পাশাপাশি একটি গুদাম সিলগালা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!