রোববার তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের তিনদিনের মধ্যেই আফগানিস্তানে ফিরেছেন সংগঠনের রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার। কাতারের দোহা থেকে একটি বিশেষ বিমানে করে মঙ্গলবার আরও ক’জন সিনিয়র তালেবান নেতাকে নিয়ে তিনি কান্দাহারে নামেন।
আমেরিকান হামলার মুখে ২০০১ সালে তালেবানের অন্য নেতাদের সাথে প্রথমে কাবুল, তারপর দেশে ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়েছিলেন মি. বারাদার। এরপর সন্ত্রাসের মামলায় আট বছর পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছরের নির্বাসিত জীবন আর কারাবাসের পর মঙ্গলবার বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছেন তিনি।
তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর থেকেই নতুন একটি সরকার গঠনের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে এবং মোল্লাহ বারাদারের আফগানিস্তানে ফেরা ইঙ্গিত করছে যে নতুন সরকারের ঘোষণা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
কাবুলে নতুন সরকার যে মূলত তালেবানের সরকার হবে বা সেই সরকারে যে তালেবানেরই একচেটিয়া প্রাধান্য থাকবে – এ নিয়ে তেমন কোন সন্দেহ আর নেই।
যদিও হিবাতুল্লাহ আখুনজাদা তালেবানের আমির বা শীর্ষ নেতা, কিন্তু এখন পর্যন্ত যে ইঙ্গিত তা হলো কাবুলে আসন্ন সরকারের প্রধান হতে চলেছেন তার ডেপুটি মোল্লাহ বারাদার।
রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর রোববার দোহায় বসে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে তালেবানের সাদা পতাকা সামনে নিয়ে মি. বারাদারই যুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দেন। বিজয়ের এই ঘোষণা কিন্তু হিবাতুল্লাহ আখুনজাদার কাছ থেকে আসেনি।
“আফগানিস্তানে তালেবানের সরকারই আসছে এবং বারাদারই যে তাদের ইসলামী আমিরাতের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, এ নিয়ে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই,“ এমনটাই অভিমত ড. আসিম ইউসুফজাইয়ের।
যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং আফগান রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. ইউসুফজাই মনে করেন, তালেবানের মধ্যে মি. বারাদারই এখন বাকি বিশ্বের কাছে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য।
তিনি বলেন, তালেবানের বিভিন্ন অংশের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো এবং বোঝাপড়া করে জটিলতার মীমাংসা করার ক্ষমতা তার রয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমে সিংহভাগ বিশ্লেষক সেই সম্ভাবনার কথা বলছেন, যদিও সংগঠনের আমির হিবাতুল্লাহ আখুনজাদা ছাড়াও তালেবানে নেতৃত্বে আরও অন্তত দুজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন – সিরাজউদ্দিন হাক্কানী এবং তালেবানের মূল প্রতিষ্ঠাতা মোল্লাহ ওমরের ছেলে মোল্লাহ ইয়াকুব – যাদেরও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে খবর বেরিয়েছে।
তবে, পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য সংবাদপত্র ডনে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, মি. আখুনজাদাকে ২০১৬ সালে তালেবানের আমির নিয়োগ দেয়া হলেও তার ভূমিকা এবং ভাবমূর্তি এখনও একজন মৃদুভাষী ধর্মীয় নেতার।
ঈদ বা রোজার আগে বিবৃতি প্রকাশ ছাড়া তার কাছে থেকে তেমন কিছু শোনাও যায় না এবং তালেবানের সামরিক বিষয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই কম বলে ওই নিবন্ধে বলা হয়।
ড. ইউসুফজাইও মনে করেন, তালেবান তাদের ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং মি. আখুনজাদা হয়তো হবেন সেই আমিরাতের ‘সেরিমোনিয়াল চিফ (পোশাকি প্রধান)।
“কিছুটা ইরানের ধাঁচে সরকারের কাঠামো হতে পারে, যদিও ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে,“ বলেন তিনি।
কাবুল দখলের পর অনেকের মনেই এই প্রশ্ন উঠেছে যে কেমন মানুষ এই মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার, কীভাবে তার এই উত্থান? আর ক্ষমতা হাতে পেলে কীভাবে তিনি আফগানিস্তান চালাবেন?
“বারাদার কঠোর হাতে আফগানিস্তান শাসন করবেন। খুব শক্ত মনের মানুষ তিনি, খুবই শক্ত নেতা। দীর্ঘ আট বছর পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন তিনি, কিন্তু তাতে একটুও ভাঙ্গেননি,“ বলছেন ড. ইউসুফজাই।
তরুণ বয়স থেকেই যুদ্ধ করছেন তিনি। প্রথমে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে, তারপর সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর ছড়িয়ে পড়া গৃহযুদ্ধে অন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে তালেবানের উৎখাতের পর পাকিস্তানে এলেও আমেরিকানদের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সেখানে আট বছর কারাভোগও করেছেন তিনি। ফলে, আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষটি এখন ঠাণ্ডা মাথার একজন কূটনীতিক – যিনি দোহায় বসে নানা দেশের সরকারের সাথে আপোষ মীমাংসা করছেন, বিদেশ সফর করছেন – তার আড়ালে রয়েছে দীর্ঘ লড়াইয়ে পোড় খাওয়া শক্ত একজন যোদ্ধা। তালেবানের ভাষায় মুজাহিদীন।
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের নথি অনুযায়ী, মোল্লাহ বারাদারের জন্ম আফগানিস্তানের উরুযগান প্রদেশের উইটমাক নামে একটি গ্রামে। তবে তিনি বড় হন আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারে। সেখানেই একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
জাতিগত পশতুন বারাদার ১৯৭০ ও ৮০-র দশকে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্যদের তাড়াতে ১০ বছর যুদ্ধ করেন। এরপর আফগান গৃহযুদ্ধ চলার সময় মোল্লাহ মোহাম্মদ ওমরের নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে যে কয়েকজন পশতুন মুজাহিদীন তালেবান প্রতিষ্ঠা করেন, মোল্লাহ বারাদার ছিলেন তাদের অন্যতম।
মোল্লাহ ওমরের ডান হাত ছিলেন তিনি। জানা যায়, তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। মোল্লাহ ওমরের বোনকে বিয়ে করেন বারাদার।
১৯৯৬ সালে যখন তালেবান কাবুল দখল করে, তখন সেই সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন মোল্লাহ বারাদার। ২০০১ সালে আমেরিকার হামলায় তালেবান ক্ষমতা হারানোর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরে উপমন্ত্রী।
আমেরিকানদের তাড়া খেয়ে অন্য অনেক তালেবান নেতার সাথে তিনিও পালিয়ে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দাদের আশ্রয়ের ভরসা থাকলেও আমেরিকানদের হাতে ধরা পড়া বা ড্রোন হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে তাকে। আমেরিকানরা যে ক’জন তালেবান এবং আল-কায়েদা নেতাকে ধরার তালিকা করেছিল, সেই তালিকায় মোল্লাহ বারাদারও ছিলেন।
২০১০ সালে করাচীতে পাকিস্তানের পুলিশ মোল্লাহ বারাদারকে আটক করে। সে সময় পত্র-পত্রিকায় যে ছবি ছাপা হয়েছিল, তাদে দেখা যায় তাকে লোহার চেন দিয়ে হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের অনেক মিডিয়ায় তখন বিশ্লেষকরা লিখেছিলেন যে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভালো করার আশায় মোল্লাহ বারাদারকে ধরেছে পাকিস্তান। কারণ, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তালেবান এবং আল-কায়েদাকে আশ্রয় দিচ্ছে এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল।
তখন এমন সব খবরও বের হয় যে মোল্লাহ বারাদার আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা হিসাবে কাবুলে সে সময়কার প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সাথে গোপনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা আইএসআই জেনে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে আটক করলেও আমেরিকানদের হাতে তুলে দেয়নি পাকিস্তান।
সন্ত্রাসের মামলায় আট বছর পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন মোল্লাহ বারাদার। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
তখন এমন খবর বেরিয়েছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মুক্তি চেয়েছিলেন, কারণ আমেরিকা আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ করার জন্য তালেবানের সাথে মীমাংসায় বসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে লক্ষ্যে ওই সংগঠনের একজন প্রভাবশালী নেতার খোঁজ করছিলেন।
এই খবর সত্য প্রমাণিত হয় যখন মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরই মি. বারাদার দোহায় গিয়ে তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের দায়িত্ব নেন।
আমেরিকানরা আপোষ-মীমাংসার জন্য তালেবানের পক্ষে তাকেই কেন বেছে নিয়েছিল, তা খুব পরিষ্কার নয়। তবে সে সময় নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে মি. বারাদারের সাংগঠনিক দক্ষতা, স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব এবং তালেবানের তৃণমূলে তার প্রভাব নিয়ে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৯ সালে মি. বারাদার সাধারণ মানুষের মন জয় করার উপায় নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যেটি তৃণমূলে তালেবানের যোদ্ধাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল।
লন্ডনের দৈনিক সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে তালেবানকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে সাংবাদিক জুলিয়ান বোর্গার লিখেছেন, পশ্চিমা কূটনীতিকরা দেখেছিলেন যে তালেবান শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মি. বারাদারই পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কথা সবসময় শুনতে চাইতেন না এবং তিনি অতীতে কাবুলের প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
২০১৯ সালে দোহায় গিয়ে তালেবানের পক্ষে আলোচনায় নেতৃত্ব নেন মি. বারাদার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার সাথে চুক্তিতে তালেবানের পক্ষে তিনিই সই করেন।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তালেবানের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মোল্লাহ বারাদারকেই সারা বিশ্বের লোকজন দেখেছে।
“বারাদার তালেবানের এক নম্বর নেতা নন, কিন্তু বিশ্বের কাছে তিনিই এখন তালেবানের মুখ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছেন,” বলছেন ড. ইউসুফজাই। “ভালো ইংরেজি জানেন। বিশ্বের নেতাদের সাথে কথা বলছেন। বিদেশ সফরে গিয়ে তাদের ভরসা দিচ্ছেন, স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছেন। তাছাড়া পাকিস্তানের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো, চীনের সাথেও সম্পর্ক তৈরি করেছেন।”
খুলনা গেজেট/এনএম