খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ২৬৯/৯, পিছিয়ে ১৮১ রানে

বিহার নির্বাচনে এনডিএ জোটের স্বপ্ন চুরমার

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা

সদ্য অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে এই নির্বাচন ছিল অনেক দিক দিয়েই তাৎপর্য্যপূর্ণ এবং ফলাফলও হয়েছে সেরকম মানানসই ও আকর্ষণীয়।

প্রথমেই আসা যাক, এই নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলের কথায়। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা লালুপ্রসাদ যাদব ভারতের রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর পুত্র তেজস্বী যাদব এই নির্বাচনে প্রচারে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, ৭৫টি আসন এককভাবে পেয়ে নিজেকে যুবনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল তিনি। গত লোকসভা নির্বাচনে বেগুসরাইয়ে হার থেকে শিক্ষা নিয়ে বামেদের সাথে জোটে আগ্রহী ছিলেন তেজস্বী। আরটিআই করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে ‘আরবান নকশাল’দের সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে আগের নির্বাচনে ৩টি আসন থেকে এবার ১২টি আসনে উঠে এসেছে ‘নকশালপন্থী’ সিপিআই(এম-এল) [লিবারেশন]। দলিত ভোট পেতেও ব্যাপক সাহায্য করেছে নকশালপন্থীদের সাথে এই জোট। সাথে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দুটি করে আসনে খাতা খুলেছে। বেশ কিছু আসনে স্বল্প ব্যবধানে পরাজয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, দীর্ঘদিন পর ভারতে কোন নির্বাচনে কমিউনিস্ট দলগুলির এই সাফল্য নজর কেড়েছে। একেবারেই দরিদ্র বাড়িতে থেকে কাটিহার জেলার বলরামপুরে ব্যাপক ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন লিবারেশনের মেহবুব আলম। ভোট ভাগাভাগীর আশঙ্কায় তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলেমীন(মিম)-র তরুণ আইনজীবি আদিল হাসান। এই দল মধ্যবঙ্গ লাগোয়া সীমাঞ্চল অর্থাৎ আরারিয়া-পূর্ণিয়া-কাটিহার-কিষাণগঞ্জ জেলাগুলি থেকে পাঁচটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। যার মধ্যে কংগ্রেস ও রাজদ-এর দুটি করে আর সংযুক্ত জনতা দলের একটি আসন ছিল।

এই দলগুলির তরফ থেকে ভোট কেটে বিজেপিকে জেতানোর অভিযোগ প্রাপ্ত তথ্যের বিচারে নস্যাৎ হয়ে যায়। মিম-র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যতগুলি আসনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জিতেছে, তার মধ্যে কেবলমাত্র তফশীলি জাতি সংরক্ষিত রাণীগঞ্জ আসনেই মিম ও মহাজোটের মিলিত ভোট এনডিএর সামান্য বেশী হয়। যদিও সেই আসনে নোটায় মিমের দ্বিগুণ ভোট পড়েছে। মিমের সাথে জোট করে একটি আসনে জয়ী হয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি। সীমাঞ্চল লাগোয়া সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মধ্যবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর-মালদা-মুর্শিদাবাদ জেলাগুলোতে মিমের এই সাফল্যের কি প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চিন্তায় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি। সাংসদ তথা কংগ্রেস দলের রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্যে যার ছাপ ধরা পড়েছে। ৭০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১৯টিতে জেতার পর তাঁর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সাথে জোট করে ১৫০টি আসনে জেতার স্বপ্ন চৌচির হয়ে গেছে! প্রাক্তন বিদ্রোহী মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঞ্ঝির হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা(হাম) আর সাহনীর বিকাশশীল ইনসান পার্টি(ভিআইপি) পেয়েছে চারটি করে আসন। আসন সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ায় এনডিএ-তে যোগ দেওয়ার আগে অবধি এই দুটি দল মহাজোটেরই অংশ ছিল। বহুজন সমাজ পার্টির সাথে জোট না হওয়ার খেসারত মহাজোটকে দিতে হয়েছে বাছওয়ারা, টিকারি, বারাছাত্তি, সাক্রা, বেলহার, হিলসা, ঝাঝা, ভোরের মত আসনে। দফাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আসনপ্রাপ্তি বিচার করলে দেখা যায় যে এনডিএ প্রথম দফায় ৭১টি আসনের মধ্যে ২২, দ্বিতীয় দফায় ৯৪টি আসনের মধ্যে ৫১, তৃতীয় দফায় ৭৮টি আসনের মধ্যে ৫২টি আসনে জয়ী হয়েছে। যোগি আদিত্যনাথের মত নেতাদের এনে উগ্রপ্রচার, ঘরে ঘরে কান ভাঙানো এবং সর্বোপরি মুঙ্গেরে বিসর্জনের মিছিলে পুলিশের লাঠিচালনাকে কেন্দ্র করে অশান্তির ভরপুর ফায়দা নিয়েছে বিজেপি চম্পারণ, মধুবনী, দারভাঙায়। সম্প্রদায়গত ভোট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কেওটি, গৌড় বাউরাম, জলাএ, বিসফি, আউরাই, ঢাকা, সুপাউল, সুরসান্দ, ফোর্বসগঞ্জ, প্রাণপুর, জামুই প্রভৃতি কেন্দ্রগুলিতে মহাজোট মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে প্রায় ভোটই পায়নি।

বহুমাত্রিক এই নির্বাচন ভারতের রাজনীতিকে কোন দিকে মোড় নেওয়াবে বা আদৌ নেবে কিনা, তা ভবিষ্যতই বলবে। এই নির্বাচন রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের জন্য এক বিশেষ শিক্ষাস্বরূপ। সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা বিজেপি প্রায় সর্বত্রই নির্বাচনে তার ফায়দা পেয়ে থাকে, বিহারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সমেত বিজেপি-র প্রায় সব হেভিওয়েট নেতা, মন্ত্রীরা প্রচারে এসেছে, নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগানো হয়েছে, বিহারে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে, নীতিশ কুমার সেখানকার প্রশাসনকে তার হয়ে কাজ করতে বাধ্য করেছে!

কিন্তু এতো কিছু করেও ২৪৩ আসনে, এনডিএ জোট মাত্র ১২০০০ ভোটে মহাজোটকে পরাজিত করে মসনদে বসার ছাড়পত্র পেয়েছে, যা আসলে তাদের নৈতিক পরাজয়কেই চিহ্নিত করছে। এই নির্বাচনের প্রধান শিক্ষা হলো; শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে আরএসএস-বিজেপি নামক ফ্যাসিস্ট শক্তিকে হারানো সম্ভব নয়, এদের পরাজিত করতে প্রয়োজন ব্যাপক মানুষের ঐক্য গড়ে হার-না-মানা নিষ্পত্তিমূলক জন আন্দোলন।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!