বাংলাদেশে আগামী পনেরোই অগাস্টকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ওইদিন ঢাকার ধানমণ্ডিতে একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চায় আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে, দলটি যেন কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
দু’পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দেশে আবারও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এমন একটি সময় এসব ঘটনা ঘটছে, যখন নিজেদের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হামলার শিকার হয়ে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশটির পুলিশ বাহিনী।
ফলে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটি মোকাবেলা করা বর্তমান সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ ঘটনার পর টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান।
ফলে গত এক সপ্তাহে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মতো হাতে গোটা কয়েকটি এলাকার বাইরে দলটির তেমন কোনো সক্রিয় কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।
কিন্তু সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি ইতোমধ্যেই তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের একজন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির।
“গতকাল (সোমবার) আমার সঙ্গে কথা হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. কবির।
যদিও ঠিক কী নিয়ে কথা হয়েছে, সেটি জানাতে রাজি হননি আওয়ামী লীগের এই নেতা।
তবে দলটির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালনকে উপলক্ষ্য করে আবারও নিজের অস্বিত্ব জানান দিতে চায় আওয়ামী লীগ।
ওইদিন ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে কর্মসূচি পালনের নিরাপত্তা চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
“ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বলে আমি জেনেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।
কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মী-সমর্থকদের ঢাকায় আসতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা।
এদিকে, শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক ভিডিওবার্তায় শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
“১৫ই অগাস্ট আমার আহবান আপনাদের প্রতি, শান্তিপূর্ণভাবে ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য, স্বাধীনতার চেতনার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন,” রোববার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে বলেন সজীব ওয়াজেদ জয়।
এছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকেও ১৫ই অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একাধিক ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
রুখতে মাঠে থাকবে ছাত্র আন্দোলন
১৫ই অগাস্টে আওয়ামী লীগ ঢাকায় কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও সেটি সফল হতে দিবে না বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
“গত ১৬ বছর ধরে শাসনের নামে তারা যেভাবে মানুষের হত্যা, নির্যাতন ও গুম করেছে, যত রক্ত তাদের হাতে লেগে আছে, সেগুলোর বিচার না হওয়া পর্যন্ত এদেশের ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে দেখতে চায় না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
শেখ হাসিনা এবং তার দলকে বিচারের আওতায় আনতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়েছেন এই সমন্বয়ক।
“বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে কথা বলবো,” বলছিলেন মি. আব্দুল্লাহ।
কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনও বেশ বড় এবং নিষিদ্ধ কোনো সংগঠনও নয়। তাহলে তাদেরকে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না কেন?
“কারণ সুযোগ পেলেই তারা আবারও রক্তপাত ঘটাবে, মানুষের জীবন যাবে,” বলেন সমন্বয়ক মি. আব্দুল্লাহ।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে অবৈধ আগ্নেয়ান্ত্র রয়েছে বলেও দাবি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
“আন্দোলন চলাকালে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছুঁড়েছে, সেটা সবারই জানা। এরপর থানা থেকেও ওরা অস্ত্র লুট করেছে,” বলেন মি. আব্দুল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, “এ অবস্থায় তাদেরকে আবারও রাজপথে নামার সুযোগ দিলে আবারও এদেশের মানুষের রক্ত ঝরবে, প্রাণ যাবে। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না।”
রাজপথে নামতে না পেরে প্রশাসনের অনুগত কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
“সম্প্রতি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ক্যু করার চেষ্টা আমরা প্রতিহত করেছি। একইভাবে, আরও নানান ষড়যন্ত্র চলছে, যা আমরা কোনোভাবেই সফল হতে দেব না,” বলেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
“এর কারণে যদি আমাদেরকে মাসের পর মাসও রাজপথে থাকতে হয়, আমরা থাকবো। তারপরও ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না,” বলেন তিনি।
বিএনপিও আছে রাজপথে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ যখন মুখোমুখি অবস্থানে, তখন চুপচাপ বসে নেই বিএনপিও। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
“আমাদের নেতাকর্মীরা সব জায়গাতেই মাঠে আছেন। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম।
তবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালন করতে চাইলে তাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছে বিএনপি।
“নিবন্ধিত এবং বৈধ দল হিসেবে তারা অবশ্যই কমূসূচি পালন করতে পারে। এটা তাদের অধিকার,” বলছিলেন মিজ ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, “কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ যেভাবে ফুঁসে উঠেছে, তাতে তারা শেষ পর্যন্ত নিরাপদে কর্মসূচি পালন করতে পারবেন কী-না সন্দেহ আছে।”
এছাড়া কর্মসূচি পালনের নামে মানুষের উপর হামলা হলে বিএনপি সাধারণ নাগরিকদের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলেও জানিয়েছেন মিজ ইসলাম।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন দখল করে নেয়ছবির উৎস,Getty Images
ছবির ক্যাপশান,শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন দখল করে নেয়
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
আওয়ামী লীগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি অবস্থানের ঘটনায় সাধারণ নাগরিকদের অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।
“কিছুদিন আগেই দেশের এতগুলো তাজাপ্রাণ অকালে ঝরে গেলো। আবারও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, আমরা সেটা চায় না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকার তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা নাহিদা আখতার।
ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী মিজ আখতার সাম্প্রতিক আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণহানির ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন।
“নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে আওয়ামী লীগ সরকার মানুষহত্যা শুরু করায় তখন আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিলাম। অনেক রক্তের বিনিময়ে তাদের পতন হলো। এখন আর রক্ত দেখতে চাই না, শান্তিতে থাকতে চাই,” বলছিলেন মিজ আখতার।
একই কথা বলছিলেন সিএনজি চালক আবুল বাশার।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আন্দোলন হইলে আমরা যাত্রী পাই না, আয় রোজগার হয় না, গাড়ি পোড়ে। এগুলো আর চাই না।”
খুলনা গেজেট/কেডি