তৃণমূল কংগ্রেসের তৃতীয় সরকারের মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠকে (১৭.৫.২১) রাজ্য আইনসভায় বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গ্ৰহণ করা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি তাঁর দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের দিনই জানিয়েছিলেন এবার তাঁরা সরকার গঠন করলে বিধান পরিষদ ফিরিয়ে আনবেন। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারেও বিধান পরিষদ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এদিক থেকে দেখতে গেলে মন্ত্রিসভায় বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গ্ৰহণ একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রাথমিক প্রয়াস মাত্র।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১১ সালে প্রথমবার সরকার গঠনের পরও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু বামেরা তখন বিরোধিতা করায় তিনি বিষয়টি নিয়ে আর অগ্ৰসর হননি। দ্বিতীয় সরকারের সময় অবশ্য ওই ব্যাপারে তিনি নীরব থাকেন। এবার প্রথম থেকেই উদ্যোগী হয়েছেন।
বিধান পরিষদ রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ আর বিধানসভা নিম্নকক্ষ। আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী, বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভার আসন সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। তবে তা হবে কমপক্ষে চল্লিশ। আসনগুলো কয়েকটি পর্বে পূরণ করা হয়। বিধানসভার বিধায়করা বিধান পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ বিধায়ক নির্বাচিত করেন। পঞ্চায়েত, পুরসভা ও পুরনিগমের সদস্যরাও এক-তৃতীয়াংশ বিধায়ক নির্বাচিত করতে পারেন। এক-ষষ্ঠাংশ সদস্য মনোনীত করেন রাজ্যপাল। বারো ভাগের এক ভাগ সদস্য নির্বাচন করেন স্নাতকরা। স্নাতকদের সমান সদস্য নির্বাচন করে শিক্ষক সমাজ। বিধান পরিষদের কার্যকালের মেয়াদ ছ’বছর। প্রতি দু’বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ আসন শূন্য হয়। উচ্চকক্ষ স্থায়ী। নিম্নকক্ষ নির্দিষ্ট মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছরের পূর্বে ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু উচ্চকক্ষ ছ’বছরই বহাল থাকে।
বর্তমানে ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ছ’টি রাজ্যে- উত্তরপ্রদেশ, অন্ধপ্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, বিহার ও তেলেঙ্গানা- বিধান পরিষদের অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ দেশের তিন-চতুর্থাংশের বেশি রাজ্যে শুধুমাত্র বিধানসভা নিয়ে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা কাজ করছে। অবশ্য আগে আরও কয়েকটি রাজ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ছিল। কিন্তু ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় আইন রচনা করে পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধান পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। পরে আরও কিছু রাজ্য থেকে বিধান পরিষদের অবলুপ্তি ঘটে। এজন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি পরিত্যক্ত ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা প্রত্যাশিত নয়।
নামে উচ্চকক্ষ হলেও কার্যক্ষেত্রে বিধান পরিষদের বিশেষ গুরুত্ব নেই। অধিকার ও এক্তিয়ারের প্রশ্নে প্রাদেশিক আইনসভার একটি অঙ্গ হিসেবে বিধান পরিষদের পরিধি অত্যন্ত সীমিত। উচ্চকক্ষে কখনও অর্থ বিল উত্থাপন করা হয় না। অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিলের ব্যাপারে বিধান পরিষদের কোনও ভূমিকাই নেই। অন্যান্য বিলের ক্ষেত্রেও বিধানসভা ও বিধান পরিষদের পারস্পরিক অবস্থান পৃথক হলে প্রথমটির অবস্থানই কার্যকর হয়। নিম্নকক্ষে পাশ হওয়া কোনও বিলকে উচ্চকক্ষ সর্বাধিক চার মাস পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। অর্থাৎ বিল পাশের প্রক্রিয়াকে বিধান পরিষদ খানিকটা বিলম্বিত করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। নিম্নকক্ষে সংখ্যালঘু হয়ে পড়লে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে, কিন্তু উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সরকারের কোনও বিপদ নেই। মনোনীত বিধায়কদের নিয়ে গঠিত বিধান পরিষদ সেভাবে কোনও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগ করে না। মন্ত্রিসভার দায়বদ্ধতা নিবদ্ধ থাকে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিধায়কদের নিয়ে গঠিত বিধানসভার কাছে।
বিধান পরিষদের বিশেষ গুরুত্ব নেই বলেই ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের আইনসভা থেকে এটি তুলে দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৯ সালে বিধান পরিষদ বিলুপ্তি বিলটি পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ, উভয় কক্ষেই সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। বিধান পরিষদের সদস্যরাও তা তুলে দেওয়ার সরকারি প্রস্তাব সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলনেতা সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বিধান পরিষদকে এপেনডিক্সের সঙ্গে তুলনা করেন। আমরা জানি, এপেনডিক্স মানব দেহের এমন একটি অঙ্গ যা বেঁচে থাকার জন্য কোনও কাজে লাগে না, কিন্তু ওখান থেকে অসুখ সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য কয়েকটি উন্নত দেশে অপারেশনের মাধ্যমে শৈশবেই এপেনডিক্স বের করে ফেলার নিয়ম রয়েছে।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তসমূহের দ্রুত ছাড়পত্র প্রাপ্তির প্রশ্নে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেক সুবিধাজনক। বিধান পরিষদে শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে সরকার পরিচালনায় একটা সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। কোনও জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিলের অনুমোদন অন্তত কিছুদিনের জন্য আটকে যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ গঠিত হলে তার সদস্য সংখ্যা হবে ২৯৪ আসনবিশিষ্ট বিধানসভার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৯৮। উচ্চকক্ষের সদস্যরা নিম্নকক্ষের সদস্যদের মতোই বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। কিন্তু তাঁরা মনোনীত সদস্য বলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করবেন না। অর্থাৎ পরোক্ষ নির্বাচন ও মনোনয়নের মাধ্যমে রাজ্যে বিধায়কের সংখ্যা বাড়বে কিন্তু গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ ঘটবে না। আবার উচ্চকক্ষের সদস্যরা সকলেই উচ্চমানসম্পন্ন হবেন এবং শাসনপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং অনেকেই শাসকদল বা সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করার পুরস্কার হিসেবেই উচ্চকক্ষে প্রবেশের টিকিট পেয়ে যাবেন। সক্রিয় রাজনীতিক ও শাসকদলের সাপোর্টার শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষক-সাংবাদিক যাঁদের অন্যত্র ‘অ্যাকোমোডেট’ করা যায়নি তাঁরা উচ্চকক্ষের সদস্য হবেন। ‘দলবদলু’ নেতানেত্রী আর ‘মতবদলু’ বুদ্ধিজীবীরা পুনর্বাসন পাবেন। কিন্তু শাসকের অন্ধ সমর্থক-স্তাবক বৃদ্ধির স্বার্থে একেবারে আইনসভার অন্দরে নতুন পরিসর সৃষ্টির পরিকল্পনা সঙ্গত নয়। ঋণের অর্থের ওপর নির্ভরশীল একটা রাজ্যের রাজকোষের অর্থের অপচয় একেবারেই অনুচিৎ। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির বিচারে বিধান পরিষদ গঠন একটি জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
বিধান পরিষদের সমর্থকরা বলতে পারেন, রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের আইনসভায় আনতে পারলে তাঁদের পরামর্শ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু এই যুক্তির বিশেষ জোর নেই কারণ রাজ্য পরিচালনার কাজে রাজ্যের অরাজনৈতিক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের পরামর্শ পাওয়ার জন্য তাঁদের আইনসভার সদস্য করার দরকার পড়ে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এমন ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া কঠিন নয় যাঁরা কোনও পদে না থাকলেও রাজ্যের স্বার্থে পরামর্শ প্রদান করতে সবসময়ই প্রস্তুত আছেন। একইভাবে কেন্দ্রীয় আইনসভায় উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অস্তিত্বের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে প্রাদেশিক আইনসভায় উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের প্রবর্তন অথবা প্রত্যাবর্তন তুলনীয় হতে পারে না। আমাদের বিশাল দেশের জাতীয় রাজনীতি সহ সার্বিক সংস্কৃতি যতটা বৈচিত্র্যময়, কোনও একটা অঙ্গ রাজ্যের সীমাবদ্ধ আঞ্চলিক পরিবেশ নিশ্চয়ই সেরূপ হওয়ার দাবি করতে পারে না।
তবে অর্ধ শতক পরে পশ্চিমবঙ্গের আইনসভায় বিধান পরিষদের প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বিধান পরিষদ গঠনের রাজ্য আইনসভার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় আইনসভার অনুমোদন পাবে বলে মনে হয় না। বর্তমান রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মধুর’ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এটা সহজেই অনুমান করা যায়। তাছাড়া, ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার অধস্তন কর্তৃপক্ষকে একটা চার চাকার গাড়িতে অকারণে পঞ্চম চাকা জুড়ে ব্যয় বৃদ্ধিকে প্রশ্রয় দেবে কেন? স্মরণ করা যেতে পারে, রাজ্যের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত মমতা ব্যানার্জির সরকারের একাধিক প্রস্তাব ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নাকচ হয়ে গিয়েছে।
২০১১ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি রাজ্যের ইংরেজী নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর বদলে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ করার প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যের নাম বাংলায় ‘বাংলা’, ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ এবং হিন্দীতে ‘বঙ্গাল’ করার পাঠানো প্রস্তাবেও নরেন্দ্র মোদির সরকার সম্মতি দেয়নি। ২০১৮ সালে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি- তিনটি ভাষাতেই রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ করার প্রস্তাবও কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়। একইভাবে বিধান পরিষদ গঠনের অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
খুলনা গেজেট/এনএম