২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ তাঁর পৃথিবী ছেঁড়ে বিদায় নেবার দিন। পরনে ঢিলেঢালা মলিন প্যান্ট, ছেঁড়া কোট-টাই, মাথায় কালো ডার্বি হ্যাট, হাতে ছড়ি, পায়ে পুরোনো বুট এবং বিখ্যাত গোঁফ সিনেমার এই চেহারাতেই মানুষটাকে সবাই চেনে। তিনি হলেন চার্লি স্পেনসার চ্যাপলিন। এছাড়াও তাকে ‘শার্লট’, ’কার্লিটোস’, ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প (ভবঘুরে)’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন লন্ডনে । তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে। বাবা-মা মঞ্চে অভিনয় করতেন। যখন তার তিন বছর বাবা-মা আলাদা থাকতে শুরু করেন। তিনি আর সৎ বড় ভাই সিডনি মায়ের সাথে থাকতেন। জীবনযুদ্ধে প্রতিদিন লড়াই করতে গিয়ে মা অসুস্থ হয়ে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হলে সাত বছর বয়সে তাকে প্রাথমিকভাবে একটি অনাথাশ্রমে এবং পরবর্তীতে অসহায় ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য তৈরি স্কুলে যেতে হয়। প্রায় দুই বছর এভাবে কাটানোর পর অল্প সময়ের জন্য চ্যাপলিন মায়ের দেখা পান। মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কিছুদিনের জন্য তার বাবার কাছে পাঠানো হয়। বাবা মদ্যপ ছিলেন ও অন্য একজনের সাথে তখন থাকতেন। সেখানে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি বালক চ্যাপলিনের।
আট বছর বয়সেই অভাবের তাড়নায় তিনি ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামক একটি যাত্রাদলের সাথে যুক্ত হন। তাঁর মঞ্চাভিনয় দর্শকদের নজর কাড়তে শুরু করে। এরপর তিনি ছোটখাট আরও নানা মঞ্চে, নানা প্লাটফর্মে অভিনয়ে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। কর্মজীবনে ঢোকার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯০৮ সালে তিনি ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’তে যোগদান করেন। সেই সময়ে ব্রিটেনের এই বিখ্যাত কোম্পানিটি হাস্যরসাত্মক নাটক তৈরি করতো ও দেশ-বিদেশের নানান স্থানে প্রদর্শনী করে বেড়াতো। ১৯১০ সালে ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’ তাকে মঞ্চনাট্য প্রদর্শনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। প্রায় দুই বছর ওই দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজের অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শন করার পর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। এর কয়েক মাস পরই আবারও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় তাকে।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চ্যাপলিনকে তাদের সাথে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। চ্যাপলিন ‘কিস্টোন স্টুডিও’তে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তার সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিলো ১৫০ ডলার। এই স্টুডিওর অধীনেই তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪) মুক্তি পায়, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন তিনি। তিন বছরের মধ্যে তার পারিশ্রমিক প্রায় দশগুণ বেড়ে যায়। প্রথমদিকে, তিনি নানান পরিচালকের পরিচালনায় অভিনয় করলেও পরবর্তীতে পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন। ধাপে ধাপে তিনি সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন।
১৯১৪ সালে চার্লি পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন Caught in the Rain সিনেমাতে, যা তাকে খুবই জনপ্রিয়তা দেয় এবং তার জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। ১৯১৬ সালে ‘দ্য মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ এর সাথে চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত ছিল, চ্যাপলিন ১২টি চলচ্চিত্র তৈরি করে দেবেন এবং বিনিময়ে কাজ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত বার্ষিক ‘ছয় লক্ষ সত্তর হাজার’ মার্কিন ডলার করে পাবেন। তিনি আঠারো মাসে চুক্তির শর্ত পূরণ করেন এবং মিউচুয়াল কর্পোরেশনকে ১২টি চলচ্চিত্র উপহার দেন।
এরপর তিনি ‘ফার্স্ট ন্যাশনাল’ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন । তাদের সাহায্য নিয়ে তিনি নিজস্ব স্টুডিও তৈরি করেন । ১৯১৯ সালে তিনি আরও কয়েকজন অংশীদারকে নিয়ে ‘ইউনাইটেড আর্টিস্টস’ নামক চলচ্চিত্র-নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । তার পরবর্তী কাজগুলো দ্য কিড (১৯২১), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫), দ্য সারকাস (১৯২৮), সিটি লাইটস (১৯৩১), মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০) এর অধীনেই হয়েছিলো। তার প্রায় সব সিনেমাগুলোই নির্বাক।
শৈশবে কঠিন লড়াই করে পরবর্তীতে বিশ্বমঞ্চে সেরাদের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া সহজ কাজ ছিল না- চার্লি চ্যাপলিন সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন। তীব্র বেদনাদায়ক শৈশব হলেও চ্যাপলিন জীবন সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শিখেছিলেন। তিনি চারপাশের মানুষ, সমাজকে নিয়ে ভাবতেন এবং সমাজকে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। সমাজ সম্পর্কে তার তার পর্যবেক্ষণ ছিলো অত্যন্ত গভীর। তার প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কোনো না কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, ‘দ্য কিড’ চলচ্চিত্রটিতে আমরা দারিদ্র্য, বাবা-মা’র বিচ্ছেদ ও এক শিশুর অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলা দেখি।
তার জীবনদর্শনে জীবন থেকে রাজনীতিকে তিনি আলাদা করতে পারতেন না। তার বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের কারণে তিনি সমালোচনার বানে জর্জরিত হয়েছেন বহুবার। ক্ষেত্রবিশেষে কখনো কখনো তাকে দুর্দশা বরণ করতে হয়েছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় ও মাতৃভূমির পক্ষে যুদ্ধে যোগ না দেওয়ায় সমালোচিত হন ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমে । ১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে তৈরি করা সিনেমা ‘মডার্ন টাইমস’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। এই সিনেমাতে তিনি বেকারত্বের উপর শিল্পায়নের প্রভাব তুলে ধরেন এবং পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন। এই সময় থেকে তাঁর উপরে রাজনৈতিক সমালোচনা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। তিনি রাজনীতিবিদদের একাংশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।
১৯৪০ সালে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন। এই সিনেমায় তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরেন। মার্কিনীরা এতে ‘বামপন্থা’ খুঁজে পান এবং তার বিরুদ্ধে আক্রমণ আরো বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চ্যাপলিন নানাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করেন। এতে কম্যুনিজমের পক্ষে তার অবস্থান আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী শক্তি অনুধাবন করতে পারে যে, কেন চ্যাপলিনের সিনেমাগুলোতে শোষিত শ্রেণীর দুর্দশা তুলে ধরা হয়েছে, শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের একাংশ তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়ানোর জন্য বাহানা খুঁজতে থাকেন। তিনিও সেটা অনুমান করতে পারেন। ১৯৫২ সালে তার ‘দ্য লাইমলাইট’ তিনি মার্কিন দেশে মুক্তি না দিয়ে ইংল্যান্ডে মুক্তি দেবার লক্ষ্য নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়ে মার্কিন সরকারের আচরণে বিরক্ত চ্যাপলিন এরপরে ২০ বছর মার্কিন দেশে আর আসেন নি।
একাধিক সৃজনশীল কাজে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালনা, অভিনয় ও অর্থায়ন করতেন এবং সেগুলোতে ব্যবহৃত গান বা সুরও নিজেই লিখতেন। তার জীবন থেকে আমরা একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের শিক্ষা পাই। প্রাচুর্য ও সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করেও তিনি ছেলেবেলার স্মৃতিকে ভুলে যাননি। তিনি বিলাসীতায় গা ভাসিয়ে দেননি। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি হাল ছেড়ে দেননি, জীবনকে সব সময়ে তিনি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন, সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন। তার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও মানুষের কষ্টকে হাসির মাধ্যমে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলতেন যে তার অভিনয় দেখা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ক্ষণিকের জন্য তাদের দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা ভুলে না হেসে থাকতে পারেনি।
তিনি একটি দুর্বিষহ শৈশব পার করে এলেও জীবনের কাছে কখনো হার মানেননি। তিনি বলতে পেরেছিলেন – “ আসুন অসম্ভবের জন্য সংগ্রাম করি। যেগুলোকে অসম্ভব মনে করা হতো সেগুলোকে জয় করার মধ্যে দিয়েই ইতিহাসের বড় বড় অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছে”। তাই তিনিই বলতে পারেন , “জীবন হতে পারে চমৎকার যদি আপনি একে ভয় না পান। এর জন্য প্রয়োজন সাহস, কল্পনাশক্তি আর অল্প কিছু টাকাকড়ি”।
লেখক পরিচিতিঃ সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।