তখন বড় বিদ্যাপীঠ বলতে দৌলতপুর বিএল একাডেমী। সিটি, কমার্স ও সুন্দরবন কলেজ স্থাপিত হয়নি। সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে আর.কে গার্লস কলেজ (খুলনা সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়)। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ ঢাকা থেকে খুলনায় এসে পৌঁছেছে। বি.এল একাডেমীতে সভা, মিছিল ও পোষ্টারিং হচ্ছে। তখনকার দিনে পোষ্টার লেখা হতো সংবাদপত্রের ওপর। পোষ্টারের ভাষা ছিল “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”।
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার কথা উত্থাপন করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ কে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তার ২ মাস আগে ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আত্মপ্রকাশ করে। খুলনা ও যশোর এলাকায় তখনও ছাত্রলীগের কমিটি গঠন হয়নি। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ খুলনার সন্তান। তিনি মাঝে মধ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে খুলনা ও বাগেরহাট সফর করতেন। বি.এল একাডেমীতে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলতে মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন সক্রিয় হয়। এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা হচ্ছেন ছাত্র ফেডারেশনের স্বদেশ বসু, সন্তোষ দাশ গুপ্ত, ধনঞ্জয় দাস, কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়, সরদার আনোয়ার হোসেন, মুসলিম ছাত্রলীগের তাহামিদ উদ্দিন, মতিয়ার রহমান, জিল্লুর রহমান, এ.এফ.এম আব্দুল জলিল, আবু মুহম্মদ ফেরদাউস, আফিল উদ্দিন, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, মালিক আতাহার উদ্দিন, এম.এ বারী প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ৩ দিন আগে মুসলিম ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ৮ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। দৌলতপুরে সভার আয়োজন করলে মুসলিম লীগ সমর্থকরা গোলমাল করার চেষ্টা করে। মারপিট করে কয়েকজনকে জখমও করে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী ৯২ পাতা)। কিন্তু ভাষার দাবীতে সেদিনকার সভা পন্ড করতে পারেনি। ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এখানকার সভায় বক্তৃতা করেন। তখন মুসলিম লীগের প্রভাব বেশী ছিল খুলনা অঞ্চলে। মুসলিম লীগ নেতা আব্দুস সবুর খান (পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী) এর হস্তক্ষেপে পরিস্থিািত শান্ত হয়। পরে ছাত্র সভা সম্পন্ন হয়। খান এ সবুর ঐ সময় মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মসূচিকে সমর্থন করেন। বি.এল একাডেমীতে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র ফেডারেশনের আনোয়ার হোসেন ও স্বদেশ বসু গ্রেফতার হয়। আনোয়ার হোসেনকে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে ছাত্র ফেডারেশনের এই নেতা আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। স্বদেশ বসুর ৭ বছর জেল খাটতে হয়, ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিহত হন। খুলনা জেলে মুগুর পেটা করে হত্যা করা হয় বিষ্ণু বৈরাগীকে।
খুলনার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে তমুদ্দিন মজলিশ আর নয়া সাংস্কৃতিক সংসদ। তমুদ্দিন মজলিশের নেতৃত্বে ছিলেন এ্যাডঃ এস.এম আমজাদ হোসেন (পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী) ও এ্যাডঃ মোঃ মোমেন উদ্দিন আহম্মেদ (জাপা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী)। নয়া সাংস্কৃতিক সংসদের নেতৃত্বে ছিলেন এম.এ গফুর (কাজী মোতাহার রহমান রচিত ‘খুলনায় বঙ্গবন্ধু’)। তিনি খুলনায় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কের দায়িত্বও পালন করেন। প্রথম দিকে গণতন্ত্রী পার্টি, পরে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদান করে খুলনা-৪ আসন (পাইকগাছা) থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
খুলনা গেজেট/এমএম