সতের বছর বয়সী কিশোরি। পড়তো কলেজে। মাত্র কিছু মাস আগে জুলাই অভ্যুত্থানে হারিয়েছে বাবা জসিমকে। এর মাঝেই সারাদেশ শিউরে ওঠে জুলাই আন্দোলনের শহীদ-কন্যার সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সংবাদে। কিন্তু বিভীষিকার শেষ সেখানেই নয়। গোটা জাতির স্নায়ু কাঁপিয়ে দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো কিশোরি লামিয়া।
পটুয়াখালীর দুমকিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার জুলাই আন্দোলনে শহীদ জসীম উদ্দিনের কলেজছাত্রী মেয়ে লামিয়া আক্তার আত্মহত্যা করে গত শনিবার (২৬ এপ্রিল)। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার ৬ নম্বর রোডের বি/৭০ নম্বর বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ মার্চ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এই শহীদকন্যা।
লামিয়ার বাবা শহীদ জসীম উদ্দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। শহীদ বাবাকে দুমকি উপজেলার বাড়িতে দাফন করা হয়। রোববার বাদ মাগরিব পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাংগাশিয়া ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে বাবার কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত ৯টার দিকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন লামিয়া। পরে তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
লামিয়ার মৃত্যুর কিছু সময় পরপরই ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যায় জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তীর একটি পোস্ট। আত্মহত্যার কিছু সময় আগে লামিয়ার সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। কাটানো সেই সময়ের মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন শ্রাবন্তী।
সাবরিনা আফরোজ বলেন, ‘সবচেয়ে কষ্টের কথা কি জানেন? আজকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা পর্যন্ত আমি তাদের বাসায় ছিলাম! আমি গল্প করলাম তাদের সাথে, একসাথে খাটে বসে চানাচুরের বাদাম বেছে বেছে খেলাম দু’জন মিলে! বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো! বললো, ‘আল্লাহ যা করে, সেটা নাকি ভালোর জন্যেই করে। আমার কি ভালো করসে বলতে পারেন? আমার সাথে খালি খারাপ ই হইসে!’’
গত ১৮ মার্চ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন লামিয়া। সন্ধ্যায় বাবার কবর জিয়ারত শেষে নানাবাড়ি পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে যাচ্ছিলেন তিনি। ফেরার পথে নলদোয়ানী থেকে অভিযুক্তরা পিছু নেয়। হঠাৎ পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে পার্শ্ববর্তী জলিল মুন্সির বাগানে নিয়ে যায় অভিযুক্ত সাকিব ও সিফাত। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সময় এজাহারভুক্ত আসামিরা তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলে। এরপর ২০ মার্চ দুমকি থানায় মামলা করেন লামিয়া।
মামলার এজাহারে উপজেলার একটি ইউনিয়নের দুজনের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলা হওয়ার দিন রাতে এজাহারভুক্ত ১৭ বছর বয়সী কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২১ মার্চ অন্য আসামিকে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে তাদের যশোর শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
সাবরিনা আফরোজের মতে, ‘লামিয়ার মৃত্যু শুধু ধর্ষণের ঘটনার ট্রমা থেকে নয়, বরং সমাজের ফিসফাস, কটূক্তি, সন্দেহ, ও চরিত্রহরণের সংস্কৃতি তার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বাসার আশপাশের মানুষের কানাঘুসা ও নোংরা ইঙ্গিত তাকে মানসিকভাবে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেয়, যেখানে আর বেঁচে থাকার শক্তি ছিল না।’
লামিয়াদের প্রতিবেশী জামিলা খাতুন জানান, ‘সন্ধ্যার পর মা-মেয়ে মিলে কাপড় কিনে এসেছে। আগামীকাল বিকেলে লঞ্চে করে বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। শনিবার রাতে ছোট মেয়েকে নিয়ে মাদরাসায় যাওয়ার পর বড় মেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেছে। হয়তো কেউ তাকে ফোনে এমন কোনো হুমকি-ধমকি দিছে, যার কারণে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা এ হত্যার বিচার কার কাছে আর চাইবো?’
পটুয়াখালীর দুমকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লামিয়ার ময়নাতদন্তের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
খুলনা গেজেট/জেএম