খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

খুলনায় বাবাকে হত্যার দায় নিয়ে থানায় কিশোরী মেয়ে

একরামুল হোসেন লিপু

বাবাকে হত্যা করে থানায় হাজির হয়েছেন খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা এলাকার এক কিশোরী। গত শুক্রবার রাতে দৌলতপুর থানায় হাজির হয়ে তিনি দাবি করেন, তার শেখ হুমায়ুন কবিরকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ও বালিশ চাপা দিয়ে তিনি হত্যা করেছেন।

নিহত শেখ হুমায়ুন কবির নগরীর দৌলতপুর থানার দেয়ানা উত্তরপাড়া এলাকার নেসার উদ্দিন সড়কের বাসিন্দা। থানায় আত্মসমপর্ণ করা কিশোরী তার ছোট মেয়ে। তাকে বর্তমানে কেএমপির ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে।

দৌলতপুরে গিয়ে জানা গেছে, শেখ হুমায়ুন কবির নামাজী পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তার দুই মেয়ে উশৃংখল জীবন যাপন করতেন। এটা নিয়ে প্রায় মেয়েদের বকাঝকা করতেন তিনি।

৫২ বছর বয়সী সুস্থ, সবল শেখ হুমায়ুন কবির প্রতিদিন মুসল্লিদের সাথে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। প্রতিদিনের ন্যায় ৪ জুলাই দৌলতপুর থানাধীন দেয়ানা উত্তরপাড়া জামে মসজিদে মুসল্লিদের সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করে পার্শ্ববর্তী নিজ বাড়িতে চলে যান। ঐদিন মসজিদে তিনি আর এশার নামাজ পড়তে আসেন নাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিবেশী এবং মুসল্লিরা ফজরের নামাজ শেষে জানতে পারেন হুমায়ুন কবির মারা গেছেন। তার হঠাৎ এই অস্বাভাবিক মৃত্যু স্বজন, প্রতিবেশী এবং মুসল্লিদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। হুমায়ুন কবিরের মৃত্যু জানাজানি হওয়ার পর থেকেই আশেপাশের লোকজন ভিড় জমাতে থাকে তার বাড়িতে। স্ত্রী, কন্যাদের, আচার-আচরণ এবং কথাবার্তা শুনে প্রতিবেশীদের মধ্যে কিঞ্চিত সন্দেহ দানা বাঁধে। হুমায়ুন কবিরের মৃত্যু নিয়ে এলাকায় গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। সেই গুঞ্জনের সত্যতা মেলে ঘটনার এক সপ্তাহ পর। ১২ জানুয়ারি নিহত হুমায়ুন কবিরের ছোট মেয়ে সুমাইয়া বিনতে কবির দৌলতপুর থানায় হাজির হয়ে পিতার মৃত্যুর জন্য নিজের দায় স্বীকার করলেও ধোঁয়াশা কাটছে না। রহস্য থেকে যাচ্ছে। রাতে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে পিতাকে হত্যা করা হয়েছে বলে সুমাইয়া বিনতে কবির পুলিশকে বলেন। দৌলতপুর থানা অফিসার ইনচার্জ প্রবীর বিশ্বাস বলছেন, সুমাইয়া বিনতে কবিরের কথাবার্তা অসংলগ্ন। সে একেক সময় একেক রকম কথা বলছে। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে।

রবিবার (১৪ই জুলাই) সরজমিনে দেয়ানা উত্তরপাড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন নিহত হুমায়ুন কবিরের স্বজন এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন রাতের খাবার খেয়ে হুমায়ুন কবির নিজ শয়ন কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তার মৃত্যু এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় সে স্টক করে মারা গেছে। পরবর্তীতে মৃতদেহ গোসল করানোর সময় বাম হাতের বাহুতে দুইটা ছিদ্র দেখা যাওয়ায় অনেকে ধারণা করতে থাকে সাপের কামড়ে হয়তো তার মৃত্যু হয়েছে।

প্রতিবেশী এবং এবং নিহত হুমায়ুন কবিরের চাচাতো ভাইদের কাছ থেকে জানা যায়, হুমায়ুন কবিরের তিন মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগে। ছোট দুই মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে পৈত্রিক ভিটার দোতলা বাড়ির নিচ তলায় বসবাস করতেন। দোতলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন করেন বড় ভাই শেখ নজরুল ইসলাম। হুমায়ুন কবিরের ছোট মেয়ে সুমাইয়া বিনতে কবির এ বছর দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে। মেজো মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। দুই মেয়ের চলাফেরা এবং আচার-আচরণে হুমায়ুন কবির খুশি ছিলেন না। তাদের আচার-আচরণে তিনি খুবই বিরক্ত ছিলেন। এ নিয়ে প্রায়শই দুই মেয়ের সঙ্গে বাগ বিতন্ডা এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতো।

হুমায়ুন কবিরের চাচতো ভাই এস এম মইনুল ইসলাম বলেন, আমার চাচাতো ভাই ব্যক্তিগত জীবনে ভালো লোক ছিলেেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না। স্টক করে মারা গেছে ঠিক আছে কিন্তু হাতে দু’টো ছিদ্র ছিল। এই ছিদ্র দু’টো কোথা থেকে আসলো। আমার চাচাতো ভাই’র যেদিন মৃত্যু হয়েছে সেদিন থেকে আমাদের সন্দেহ হয়েছে এটা অস্বাভাবিক মৃত্যু।

তিনি বলেন, এটার সঠিক তদন্ত হোক। তদন্ত হয়ে প্রকৃত যদি খুনি কেউ হয়ে থাকে তাহলে সেটা বের হয়ে আসুক। এই মৃত্যুর স্বাভাবিক তদন্ত হোক সেটাই আমরা চাই।

প্রতিবেশী দিনমজুর শেখ মো. আমির হোসেন বলেন, ভোর ৬ টায় শুনতেছি হুমায়ূন ভাই স্টক করে মারা গেছে। কাজে না যেয়ে উনার বাড়ি যেয়ে দেখি, কি সুন্দর নিলিবিলি উনি শুয়ে আছে। মুখে মরার কোন কিছু নেই। মুখ এত সুন্দর ফ্রেশ। বাড়ির লোকজন বলছে উনি স্টক করে মারা গেছে। বাড়িতে তার মেয়েরা যেভাবে চলাফেরা করছে তাতে মনে হচ্ছে না বাড়িতে কেউ মারা গেছে। আমাদের গ্রামের সবার মনে জাগে গেছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না।

আরেক প্রতিবেশী দিনমজুর ইব্রাহিম শেখ বলেন, তার মৃত্যু নিয়ে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। হাতে দু’টো ছিদ্র ছিলো। এছাড়া তার শরীরে কোন সমস্যা ছিল না। আশে-পাশের সবাই আলোচনা করছে তাকে সিরিঞ্জ দিয়ে মারা হয়েছে। তাদের বাড়ির ছেলে-মেয়ে সবাই হাসি-খুশি লাগতেছে। তারা কিছুই বোধ করতেছে না। তার মৃত্যু নিয়ে একটা রহস্য আছে।

নিহত হুমায়ুন কবিরের বড় মেয়ে, মরিয়ম বলেন, বাবার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশার ভিতরে আছি। এখনো মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। পারিবারিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। খুব চাপের ভিতর আছি। সকাল থেকে অনেকে ফোন করে বিরক্ত করছে। আমাকে আর বিরক্ত করেন না প্লিজ ভাইয়া।

দৌলতপুর থানা অফিসার ইনচার্জ প্রবীর কুমার বিশ্বাস বলেন, ঘটনার এক সপ্তাহ পর ১২ জুলাই থানায় এসে নিহত হুমায়ুন কবিরের ছোট মেয়ে সুমাইয়া বিনতে কবির প্রথমে বলেন, আমি আমার বাবাকে রাতে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছি। কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার বলে আমি বাবাকে হত্যা করিনি আমার ঘাড়ে জ্বীন আছে সে জ্বীন হত্যা করেছে। তার অসংলগ্ন কথাবার্তায় আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। তার মা বলছে তার মেয়ের মানষিক সমস্যা আছে। তিন বছর আগে তাকে একবার মানষিক ডাক্তার দেখানো হয়েছিলো। থানায় কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি। এ কারণে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছি না। সুমাইয়া বিনতে কবিরকে আজ খুলনা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। আমরা আদালতের নির্দেশনায় আছি। আদালত থেকে যে নির্দেশনা আসবে আমরা সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিব।

এদিকে সুমাইয়া বিনতে কবির যে স্কুলে পড়াশোনা করেছে, সেই দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের মাধ্যমে আজ সকালে জানতে পারলাম আমাদের স্কুল থেকে ২০২৪ সালে এসএসসি পাশ করে যাওয়া সুমাইয়া বিনতে কবিরের বাবা হুমায়ুন কবির তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আজ লোকমুখে জানতে পারলাম সুমাইয়া বিনতে কবির এই ঘটনার সাথে জড়িত। সে দীর্ঘ পাঁচ বছর আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছে। আমরা তার ভিতর কখনো অস্বাভাবিক কিছু দেখি নাই। আমাদের সাথে দেখা হলে সে সালাম দিতো, কুশল বিনিময় করত।

সুমাইয়া বিনতে কবিরের শ্রেণী শিক্ষিকা সুমিতা মল্লিকও একই কথা বলেন, সুমাইয়া বিনতে কবিরের ভিতর কখনও অস্বাভাবিক কিছু দেখি নাই। তার মানষিক সমস্যা ছিল এমন কিছু কখনো পরিলক্ষিত হয় নাই।

খুলনা গেজেট/হিমালয়/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!