খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট

বাঙালির গামছা সংস্কৃতি

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

গামছা বাঙালিয়ানার প্রতীক। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে গামছা। এটি একটি মামুলি ব্যবহায্য বস্ত্র হলেও বাঙালির সামাজিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, উৎসব ইত্যাদি ক্ষেত্রে এর নানাবিধ ব্যবহার চোখে পড়ে। এক কথায় বাঙালির জীবনাচারের সঙ্গে গামছার রয়েছে এক অটুট বন্ধন, যা গড়ে উঠেছে দীর্ঘ কালব্যাপী।

গামছা শব্দটি এসেছে গা মোছা শব্দ থেকে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িষ্যায় গামছার বহুল প্রচলন দেখা যায়। বেশির ভাগ গামছায় চেকের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। সাধারণত গামছা সেলাইবীহিন হলেও, ভারতের ওড়িষ্যায় সেলাই করা গামছার প্রচলনও নজর কাড়ে। বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের কাছে গামছা একটি প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় বস্ত্র। এ দেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে মিশে আছে এই গামছা। গানবাজনা থেকে শুরু করে গোসল শেষে গা মুছতে, চুল ঝাড়তে কত কিছুতেই না রয়েছে এর ব্যবহার।

সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির জীবনে এখনো এর চাহিদা কমেনি, বরং পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ইদানিং বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানি তাদের ফ্যাশন জগতে গামছার নানা ব্যবহার করছে। যেমন- গামছা কাপড়ের শার্ট, পাঞ্জাবি, টি শার্ট, কামিজ, ফতুয়া ইত্যাদি গরমকালে হাল ফ্যাশনের পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
গামছার ব্যবহার কবে থেকে শুরু হয়েছিল সে ইতিহাস অনেকটাই অজানা। ধারণা করা হয়, যখন থেকে মানুষ কাপড়ের ব্যবহার করতে শেখে, তখন থেকেই গামছার ব্যবহার শুরু হয়। তবে, তখন এখনকার মতো এতো রঙ বেরঙের ডিজাইন করা গামছা নিশ্চয় ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গামছার প্রচলন থাকলেও এর ব্যাপক প্রচলন রয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যে। সেখানে বাড়িতে কোনো অতিথি এলে গলায় গামছা পড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। আসামে গামছাকে বলে গামোচা। তাদের গামছার জমিন সাদা এবং চারদিকে লাল সুতার বাহার থাকে।

ইতিহাসবিদ লীলা গগৈ লিখেছেন, অহোম রাজার আমল (একাদশ শতক) থেকেই আসামে গামোচার প্রচলন শুরু হয়। এ হিস্ট্রি অব আসাম গ্রন্থে এডওয়ার্ড গেইটর বলেন, ১৭৩৯ সালে একটি গামোচার দাম ছিল ৬ (ছয়) পয়সা। সেখানকার বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় আচার-অনুষ্টান ও উৎসবে গামছার ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে বিহু উৎসবের সঙ্গে গামোচার সম্পর্ক বিদ্যমান। এ উৎসবের দিন যুবকরা মাথায় গামোচা বেঁধে নৃত্যে অংশ নেয়।

জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় দুটো জিনিস এক সঙ্গে ব্যবহার হতো। তা হলো লুঙ্গি ও গামছা। এরমধ্যে বিশেষ করে গামছা নারী ও পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করে। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় পার্বনে (যেমন- ঈদ, পুজা, মেলা, আম-কাঠালের মৌসুম, পিঠাপুলির সময়) জামাইদের নিমন্ত্রনের প্রচলন ছিল। তারা সপরিবারে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এলে মেয়েদের শাড়ি এবং জামাইদের উপহার হিসেবে লুঙ্গি ও গামছা দেয়া হতো।

ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, গ্রাম বাংলার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ধুতি, লুঙ্গি, চাদর, ফতুয়া, গামছা ইত্যাদি। সাধারণত গামছা পরেই তারা বিবিধ কায়িক শ্রমে নিয়োজিত হতো। এক কথায় গ্রামীণ জীবনের সাথে গামছা যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু গ্রামেই নয়, শহরে এখনও গামছার বহুল প্রচলন রয়েছে। নরম সুতায় হাতে বোনা গামছার কদর বাঙ্গালির কাছে কখনই ফুরোবার নয়। শুধু তাঁতীরাই নয় বাঙ্গালি, মণিপুরি সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হৃদয় নিংড়ানো কল্পনার রঙ ও মনের মাধুরী দিয়েও হাতে তৈরি হয় এই গামছা। তাই এসব গামছার ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকে এক একটি জনপদের সহস্র বছরের সঞ্চিত আবেগ, দক্ষতা, স্মৃতি ও ঐতিহ্য। এগুলো কেবলই সুতোর পরে সুতো দিয়ে গাঁথা কোন আটপৌরে শিল্প নয়, বরং পরম মমতা ও ভালবাসার এক একটি স্মারক।

সাধারণত গামছা বোনা হয় তাঁতে। অধুনা মেশিনে তৈরি হলেও হাতে তৈরি গামছাই বেশি জনপ্রিয়। জানা যায়, বাংলাদেশের সেরা গামছা বোনে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের তাঁতিপাড়ার গৃহিণীরা। খুলনার ফুলতলার গামছারও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। আবার ঝালকাঠির বাসন্ডা গামছারও নাম আছে দেশজুড়ে। এছাড়াও বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার অন্যতম পোশাক শিল্পনগরী সিরাজগঞ্জে ছোট-বড়-মাঝারী কয়েক হাজার তাঁত এবং কুটির শিল্পে বাহারি গামছা তৈরি হয়। ইদানিং কুিষ্টয়ার কুমারখালিতে গামছার মতো এক ধরনের মোটা তোয়ালে দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে ।

বাঙালি জীবনে গামছা

মানুষের আত্মপরিচয়ের বিধৃত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি। এ পরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রা। সহজ ভাষায় সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবন প্রনালী। বাঙালি সংস্কৃতি সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে নানা উপাদান। এগুলোর মধ্যে গামছা অন্যতম। গামছাকে বলা হয় সকল কাজের কাজী। পা থেকে মাথা-সব কিছু মুছতে, ঢাকতে, মাছ থেকে গাছ-সব কিছু ধরতে গামছার ব্যবহার চোখে পড়ে। মেয়েদের ওড়না, ঘর সাজানোর টুকিটাকি, বিয়ের গাড়ি সাজাতে, এমনকি ল্যাপটপ ও ক¤িপউটার বয়ে বেড়ানোর ব্যাগেও স্থান করে নিয়েছে গামছা। আসলে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে গামছার বহুবিধ ব্যবহারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। গামছা ভিজালে দ্রুত তা শুকিয়ে যায়। গোসল সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই পিঠের উপর গামছা শুকিয়ে যায়। তাই যে কোনো ভ্রমনে ব্যাগে বা বাক্সে খুব কম জায়গা নেয় গামছা।

ক) কৃষিকাজে গামছা: বাঙালি সংস্কৃতি মূলত কৃষিভিত্তিক। খুব ভোরে কৃষক যখন মাঠে যায় তখন কাঁধে লাঙলের সাথে একটি গামছাও থাকে। গামছার একদিকের খুঁটে বাঁধা থাকে চিড়ে-গুড়-মুড়ি। কৃষকের স্ত্রী-সন্তান পিতার জন্য বাড়ি থেকে ভাত আনতে মাটির সানকিতে গামছা বেঁধে। কৃষক কাজে বিরতি দিয়ে হাত-মুখে পানি দেয়, গামছায় মুখ মুছে সেই গামছা বিছিয়ে খেতে বসে। খাওয়া শেষে কাছের কোনো গাছের ছায়ায় গামছা বিছিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। এছাড়া ধানকাটা, পাটকাটা, মাটিকাটা ইত্যাদি কাজের সময় কোমরে গামছার বাধা নজরে পড়ে। দিনমজুরদের অনেককে মাথায় গামছা বেধে ভারী জিনিসপত্র বহন করতে দেখা যায়। আবার কাজ শেষে বিশ্রামের সময় শ্রমিকের গামছা দিয়েই একটু হাওয়া করে গা জুড়িয়ে নেয়। আবার রাখাল বালকদের ঘাড়েও গামছা দেখতে পাওয়া যায়।

খ) জীবন নির্বাহে গামছা: কিছু মানুষের জীবন ধারনের সঙ্গেও গামছা জড়িত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার তাঁত শিল্প রয়েছে। এই শিল্পে হাজার হাজার শ্রমিক গামছা বুননের কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। নারী শ্রমিকেরা নিজ হাতে তাঁতের বস্ত্র সামগ্রী ও গামছা উৎপাদন করে। গরু-মহিষের গাড়ি, রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, নছিমন, করিমন চালকদের কাছেও গামছা একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে বিবেচিত।

গ) মাছ ধরায় গামছা: মাছে ভাতে বাঙালি-কথাটি সবার জানা। আগে গ্রামের মানুষেরা কোমরে গামছা বেধে পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামত। আবার নদীর তীরের ছেলেমেয়েরা গামছা দিয়ে পোনা মাছ ধরে। বর্ষা শেষে যখন খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যায়, তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাঁটুজলে গামছা পেতে মাছ ধরে। মাছ ধরা শেষে গামছায় মাছ বেঁধে বাড়ি ফেরে। অন্যদিকে জেলেরা রোদ-বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে গামছা ব্যবহার করে থাকে।

ঘ) খাবার তৈরিতে: বাঙালি সমাজে কোনো বড় ধরনের উৎসব-আয়োজনে বাবুর্চিরা রান্না করে। তারা সাধারণত নতুন গামছা ছাড়া রান্না করে না। এটি একটি প্রচলিত রীতি। বিশেষ করে পোলাও রান্নার কাজে গামছার ব্যবহার চোখে পড়ে। আবার নানা ধরনের মিষ্টি তৈরির জন্য দুধ থেকে ছানা তুলতে হয়। ছানার মধ্যে যে তরল অংশ থাকে তা ছাড়ানোর কাজে ছানা গামছায় বেঁধে পানি ঝরাতে হয়। দরিদ্র পরিবারে টিফিন বক্সের বিকল্প হিসেবে গামছার ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। বৈশাখ মাসে আমের মৌসমে ছুরি বা চাকু না থাকলেও সমস্যা নেই। আম গামছায় মুড়ে গাছের গোড়ায় আছড়ালেই আম ফেটে আঁটি বেরিয়ে আসবে। আবার তালের রসের মধ্যে যে তেতো অংশ থাকে তা ছাড়াতে গামছায় বেঁধে রস ঝরানো হয়।

ঙ) পোশাক হিসেবে গামছা: ‘পোশাকে গামছা শুধু কাপড় হিসেবেই নয়; বরং বাংলার আবহমান ঐতিহ্য হিসেবেই উঠে এসেছে। এক সময় গামছাকে পোশাক পরিচ্ছদের অংশ হিসেবে মনে করা হতো। গ্রামের লোকজন লুঙ্গির বিকল্প হিসেবে গামছা পরিধান করত। এক সময় এখনো কেউ কেউ কখনো-সখনো গামছা পরে। ইদানিং গামছা বা গামছার নকশার কাপড়ে তৈরি ছেলেদেও শার্ট, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া এবং মেয়েদের ওড়না, শাড়ি, ব্লাইজ, সালোয়ার-কামিজ পরতে দেখা যায়। আর শীতকালে মাফলার হিসেবে গামছা দিয়ে মাথা-কান ঢেকে রাখা হয় কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে। ভারী কোনো মালামাল তুলতে বা টানতে শ্রমিকদের কোমরে বাঁধা থাকে গামছা। মাঝি দাঁড় বায়, গুণ টানে কোমরে গামছা বেঁধে। শরীরের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্যই কোমরে এই গামছা বাঁধা। কোমরে গামছা বেঁধে লাগা। এর অর্থ হলো শরীরের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানো।

চ) সাহিত্যে গামছা: বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যে গামছার ব্যবহার কম নয়। যেমন- গলায় গামছা দেওয়া। এর অর্থ কাউকে লাঞ্ছিত করা, অপমান ও জবরদস্তি করে কোনো কিছুতে বাধ্য করা। গামছা ডলা-এর অর্থ হলো গামছা দিয়ে মর্দন, গোসলের সময় গামছা দিয়ে গা পরিষ্কার করা। গামছা বাঁধা-এর অর্থ হলো গামছা দিয়ে বাঁধা। ব্যাকরণের ভাষায় এসব শব্দমালা বাগধারা হিসেবে পরিচিত। এসব বাগধারার ব্যবহার বিভিন্ন কবিতায় দেখা যায়। যেমন- পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তার এক কবিতায় গামছা-বাঁধা দইয়ের কথা উল্লেখ আছে।
আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর
বসতে দিব পিঁড়ে
বাড়ির গাছের কবরি কলা
গামছা-বাঁধা দই।
অন্যদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাহিবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে।

ছ) সঙ্গীতে গামছা: গ্রাম-বাংলার লোকসঙ্গীতের মাঝে গামছার অস্তিত্ব¡ বুঝিয়ে দেয় যে, বাঙ্গালির কাছে গামছা শুধু দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার উপকরণই নয় বরং তা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। এক কথায় বাংলার শ্বাশত রূপের সঙ্গে অনেকখানি জড়িয়ে আছে গামছা। অনেক সংগীত শিল্পীও গামছা মাথায় বেধে বা গলায় ঝুলিয়ে গান করে। এরকম একজন শিল্পী হলেন গামছা পলাশ, যিনি সব সময় মাথায় গামছা বেধে গান করেন। গায়ক আব্বাসউদ্দীন গেয়েছেন,
যদি বন্ধু যাবার চাও
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে..

জ) চলচ্চিত্র ও নাটকে গামছা: ভারত ও বাংলাদেশের অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের গলায় বা কাধে গামছা চোখে পড়ে। ভারতীয় পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ তাঁর গ্যাংগস অব ওয়াসিপুরের নায়ক-নায়িকাদের গলায় গামছা বাঁধিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হিন্দি তাশান ছবিতে অক্ষয় কুমার গামছা মাথায় বেঁধে অভিনয় করেছেন । তবে গামছা নায়ক যদি বলিউডের কাউকে বলতে হয় তবে তিনি হলেন গোবিন্দ। গলায়, মাথায়, হাতে, কোমরে-কোথায় গামছা বাঁধেননি তিনি। বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়ের ছেলে ছবিতে নায়ক ফারুক মাথায় ও কোমরে গামছা বেঁধে অভিনয় করেছেন। আবার বাবা কেন চাকর? ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক ঘাড়ে গামছা পড়ে ঠেলাগাড়ি চালাতে দেখা যায়।

ঝ) দৈনন্দিন ব্যবহারে গামছা: বাঙালি জীবনের নানা প্রয়োজনে গামছার ব্যবহার চোখে পড়ে। যদি বিছানার চাদর না থাকে, গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়া যায় পারেন। এ ছাড়া বর্তমানে গামছা দিয়ে বানানো হচ্ছে জুতা, ঝুড়ি সেট, ঝোলা ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, পানির বোতল রাখার ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ, হাতের বালা, কানের দুল ইত্যাদি। কয়েকটা বড় বড় গামছা দিয়ে তৈরি করা হয় জানালার পর্দা। ভিন্ন ধাঁচে তৈরি হয় বেডশিট, বালিশের কভার। ঘর সাজাতেও ব্যবহার হচ্ছে গামছা। বিছানার চাদর, বালিশ, সোফার কুশন কভার, ম্যাট এমনকি খাবার টেবিলের রানার হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে গামছা। ঘরের কোণে রাখা টেবিল ল্যা¤পটির ঢাকনাও গামছার তৈরি। গামছার রং অনেক উজ্জ্বল হওয়ায় এর ব্যবহারে অন্দরের শোভা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। গ্রাম বাংলায় গামছার ব্যবহার হয় শপিং ব্যাগ হিসেবেও।

ঞ) ধর্মীয় কর্মকান্ডে গামছা: আবহমান কাল থেকেই গামছা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। যেমন- ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ নামাজ পড়তে গেলে অজু করার পর হাত মুখ মুছতে গামছার প্রয়োজন পড়ে। অনেকে গামছা বিছিয়ে নামাজ আদায় করে থাকেন। গ্রামের মসজিদে, বিশেষ করে শুক্রবারে তবারক বিতরণ করা হয় গামছায় রেখে। আবার মুসলিম বিবাহরীতিতে গামছার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সনাতন ধর্মের বিবাহ রীতি, পূজা-পার্বন, অপনয়ন (পৈতা নেওয়া), দীক্ষা গ্রহণ, চন্দ্রায়ন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ইত্যাদি কর্মকান্ডে পুরোহিতকে দক্ষিণা হিসেবে শাড়ী, ধূতি, নগদ অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি গামছা দেওয়া বাধ্যতামুলক।
ট) চিকিৎসায় গামছা: কোথাও কেটে গেছে, হাতের কাছে ব্যান্ডেজ নেই, গামছা একটি তাৎক্ষণিক সমাধান। কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে গামছা ভিজিয়ে গা মোছা হয়। গ্রামের দিকে এখনো সাপে কাটা রোগীর হাতে বা পায়ে গামছা দিয়ে শক্ত করে বাধা হয়। আবার সাপে কাটলে রোগীর বিষ নামানোর সময় সাপুড়েরা (ওঝা) মাথায় ও কোমরে গামছা বেধে বিন বাজিয়ে থাকে।

ঠ) ফ্যাশন ও স্টাইলে গামছা: গামছা দেশীয় ঐতিহ্য আর সমকালীন ট্রেন্ডের যথাযথ সমন্বয়। এদেশের ছোট সোনামণিদের বউ সাজার শখ হলে গামছা পরেই লাল-টুকটুকে বউ সেজে তাদের ইচ্ছে পূরণ করে। শুধু পোশাকেই নয়; ফ্যাশন দুনিয়ায় সর্ব স্তরেই রয়েছে গামছার বহুল ব্যবহার। ফ্যাশন হাউস গুলোতে মেলে গামছা কাপড় দিয়ে তৈরি টিস্যু বক্স, ল্যাপশেড, টেবিল রানার, জুয়েলারি বক্স, কুশন কভার, শতরঞ্জি, পেইন্টিং ফ্রেম, নোটবুক ইত্যাদি। ফ্যাশনেবল ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে গামছা। রাবারের সোল, লেদার আর গামছা গিয়ে তৈরি হচ্ছে ছেলেমেয়েদের স্যান্ডেল। রয়েছে ল্যাপটপ ব্যাগও। এ ছাড়া রয়েছে রুমাল, মাথার ব্যান্ড ও ফিতা। আড়ং, বিবিয়ানা, যাত্রা, সোর্স, দেশিদশ, স্বদেশীসহ প্রায় সব দেশীয় ফ্যাশান হাউজ কাজ করছে গামছা নিয়ে। গ্রাম বাংলায় গামছার জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবীর খ্যাত কাদের সিদ্দিকী এটাকে প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং তিনি উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছেন। তিনি ব্যক্তি জীবনেও সব সময় গামছা ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন আইকন ও ডিজাইনার বিবি রাসেলের ফ্যাশনে ও শহুরে বাঙ্গালিয়ানার উৎসব অনুষ্ঠানে গামছার বহুল ব্যবহার দেখা যায়। দেশে গামছা ফ্যাশনের সূচনায় বিবি রাসেল ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনিই মূলত বাংলার এ ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। এরপর থেকে ফ্যাশনের একটি আলাদা অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গামছা। বর্তমানে গামছা নিয়ে বিশ্বের ফ্যাশন জগৎ মাতিয়ে চলছেন এদেশের তরুন ডিজাইনাররা।

ড) উৎসব আয়োজনে গামছা: বাঙালির বিভিন্ন উৎসব ও আয়োজনে গামছার ব্যপক ব্যবহার চোথে পড়ে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে তরুন-তরুনিরা হাতে, মাথায় গামছা বেঁধে থাকে। অনেকে গামছা মাথায় পরে নৃত্য পরিবেশন করে। এছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে যে মেলা বসে, সে মেলার স্টল সাজানোর অন্যতম আইটেম হলো গামছা। তাছাড়া ঈদ ও পুজার সময় নতুন গামছার ব্যবহার চোখে পড়ে। গামছা জিনস, টি-শার্টের সঙ্গে, ধুতি সালোয়ার ও টপের সঙ্গে মাথায় বেঁধে বা গলায় ঝুলিয়ে রেখেও পরতে দেখা যায় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে।

ঢ) খেলাধুলায় গামছা: গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেদের খেলার সময় কানামাছি বা রুমালচোর খেলতে গিয়ে চোখ বাঁধার জন্য গামছা কাজে লাগে। রুমালচোর খেলতে গেলে রুমালের দরকার। হাতের কাছে গামছাটাই সহজে পাওয়া যায় বলে সে প্রয়োজনও মেটে গামছা দিয়ে। হাড়িভাঙ্গা খেলায় গামছা দিয়ে চোখ বাধা হয়।

এছাড়া রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যও গ্রামের মানুষ গামছায় মাথা ঢাকে। মশা-মাছি তাড়ায় তাও গামছা দিয়েই। গামছা একেবারে পুরানো হয়ে গেলে ওটাকে লেপা-মোছার ন্যাকড়া বানানো কিংবা ঘরের ঝুল ঝাড়ার কাজে লাগানো হয়।

উৎপাদন প্রক্রিয়া আঞ্চলিক ও লোকজ হলেও এ সকল গামছা ব্যবহারিক ও শৈল্পিক মানের বিচারে অতুলনীয়। বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে গামছা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নানা রূপ দেওয়া হচ্ছে। কখনো পুরুষের পোশাকে, কখনো মেয়েদের শাড়িতে। এক কথায় বাঙালি জীবন আর গামছা যেন একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো ও উৎপাদন প্রনালীর সাথে মিশে একাকার এই গামছা।

(লেখক : ড. খ. ম. রেজাউল করিম, সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর।)

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!