খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ময়মনসিংহে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে একই পরিবারের ৪ জন নিহত
  নিখোঁজের ৪২ ঘণ্টা পর কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদী থেকে দুই পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার

বাঙালির অহংকারের সেতু পদ্মা, শুরু থেকে শেষ

বিশেষ প্রতিনিধি

সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে নির্মিত হয়েছে বাঙালির অহংকার এই সেতু। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সৃষ্টি করা এই সেতুর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ইতিহাস।

২২ জুন সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২৫ জুন (শনিবার) বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হবে, ইনশাআল্লাহ। পদ্মা সেতুর ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

তিনি বলেন, ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার ও গ্যাস লাইনের এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়সহ মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া নদী শাসনে ৮ হাজার ৭০৬ কোটি ৯১ লাখ, অ্যাপ্রোচ সড়কে এক হাজার ৮৯৫ কোটি ৫৫ লাখ, পুনর্বাসনে এক হাজার ১১৬ কোটি ৭৬ লাখ এবং ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতুর ইতিহাস

পদ্মা সেতুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা আর তা নিয়ে পরিকল্পনা করার শুরুটা অনেক বছর আগেই হয়েছিল। ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সালে এই সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিন বছরে করা হয় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা।

এরপরের বছর, ২০০৭ সালে ২৮ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পায় এটি। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। তবে তখন আশার আলো দেখেনি সেতুটি।

২০১০ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। ২০১৩ সালের মধ্যে এর প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেতুটিতে রেলপথ সংযুক্ত করে। সে বছর ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এই বছরে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি করা হয়।

২০১২ সালের ২৯ জুন দাতা সংস্থাগুলো ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। একই বছরের ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান বসানো হয়। পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩তম পিলারে ৪১তম পিলারটি বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু।

যান চলাচল উপযোগী করে তুলতে সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর। পাঁচ মাস ১৯ দিনের মাথায় গত ২৯ এপ্রিল মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার অংশে সে কাজ শেষ হয়। এরপরই সমানতালে শুরু হয় দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাই। কিন্তু তখনও বাকি থাকে সেতুতে ওঠা-নামার ভায়াডাক্টের অংশের পিচ ঢালাইয়ের কাজ।

১৯ মে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাই ও ভায়াডাক্ট পিচ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়। ২৩ মে জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাই ও ভায়াডাক্টের কাজ শেষ হয়।

সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের পর রোড মার্কিং ও রোড সাইন দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। মূল সেতুতে রোড মার্কিং করা ও রোড সাইন স্থাপনের আগে ট্রায়াল দেওয়া হয়।

২৯ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তের সারফেস সড়কে মার্কিং দেওয়া হয়। ওই দিনের ট্রায়াল সফল হয়। এরপর ১৯ মে থেকে মূল সেতুতে রোড মার্কিং ও রোড সাইনের কাজ শুরু। সেতুর ১৩ নম্বর খুঁটির থেকে এই মার্কিং শুরু হয়। যা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভায়াডাক্টে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। পরে জাজিরা প্রান্তের ৪০ নম্বর পিলার থেকে মূল সেতুতে ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয় ৯ মার্চ। ২০ এপ্রিল শেষ হয় সবগুলো ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ।

পুরো সেতুজুড়ে বসেছে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি এবং দুই প্রান্ত মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৮৭টি ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। একটি থেকে আরেকটি ল্যাম্পপোস্টের দূরত্ব প্রায় ৩৮ মিটার।

ল্যাম্পপোস্টগুলো চীনের তৈরি। প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হলেও এসব ল্যাম্পপোস্টের কোনো ক্ষতি হবে না। প্রতিটি পোস্টের ওজন ২৭৫ কেজি ও দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ২ মিটার। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে বসানো হয়েছে ১৭৫ ওয়াটের এলইডি লাইট।

পদ্মা সেতুতে চলাচলকারী যানবাহনের নিরাপত্তার জন্য সেতুর উভয় পাশে প্যারাপেট ওয়াল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে বহু আগে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬১৫০ মিটার। সেতুর উভয় পাশে প্যারাপেট ওয়াল বসানো হয়েছে ৮২০০টি। এর মধ্যে লাইটিং ব্লিস্টার সেগমেন্ট ৩২৮টি। এছাড়াও প্রি-কাস্ট প্যারাপেট ওয়াল স্থাপন করা হয়েছে ৭৮৭২টি।

১৮ এপ্রিল পদ্মা সেতুতে প্রথম রেলিং বসানো হয়। সেতুর মাওয়া প্রান্তের যানবাহন উঠার লেনে এবং জাজিরা প্রান্তে যানবাহন নামার লেনে পরীক্ষামূলকভাবে এই রেলিং স্থাপন করা হয়। এরপর বাকি রেলিংগুলোর স্থাপনের কাজ শুরু হয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি প্রতিটি ৬ মিটার করে দীর্ঘ এই রেলিংগুলো আনা হয়েছে ব্রিটেন থেকে। আর রেলিং পোস্ট আনা হয়ে দুবাই থেকে।

গরমে প্রসারণ ও শীতে সংকোচনে ফলে সেতুর যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য পদ্মা সেতুতে ৮টি এক্সপানশন জয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এক্সপানশন জয়েন্টকে মুভমেন্ট জয়েন্টও বলা হয়। এগুলো স্থাপনের পর উভয় পাশে ঢালাই করা হয়। জয়েন্টে দুই মাথায় এক্সপানশন জয়েন্টের খালি অংশে স্টিলের কভার প্লেট বসানো হয়েছে।

সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে। দুটি ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি রয়েছে। এছাড়াও উদ্বোধনী ফলককে ঘিরে সেখানে পার্ক, ফোয়ারাসহ সৌন্দর্যবধনের নানা কাজ করা হয়েছে।

নদীতে ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু। আর দুই পাশের সড়ক মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা এই সেতু। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুর কাঠামো। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

এক নজরে পদ্মা সেতু

১. সেতুর নাম : পদ্মা সেতু।

২. প্রকল্পের নাম : পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প।

৩. অবস্থান : রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। দেশের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় প্রকল্পের অবস্থান। সেতুর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর।

৪. নকশা : আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল।

৫. পদ্মা সেতুর ধরণ : দ্বিতলবিশিষ্ট। এই সেতু কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত। (যা বিশ্বে প্রথম)।

৬. পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল (মূল সেতুতে) ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

৭. ২০১৭-১৮ অর্থবছর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৫২৪ কোটি টাকা।

৮. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

৯. পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড এর আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি।

১০. পদ্মা সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা।

১১. পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে।

১২. পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার।

১৩. পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।

১৪. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটর।

১৫. পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।

১৬. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পাড়ে ১২ কিলোমিটার।

১৭. পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।

১৮. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি।

১৯. পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা রয়েছে ৬০ ফুট।

২০. পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট।

২১. পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি।

২২. পদ্মা সেতুজুড়ে বসেছে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট।

২৩. প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং হয়েছে ৬টি। তবে মাটি জটিলতার কারণে ২২টি পিলারের পাইলিং হয়েছে ৭টি করে।

২৪. পদ্মা সেতুর মোট পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৮৬টি।

২৫. সেতুটি নির্মিত হওয়ার দেশের মোট জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।

২৬. ভূমি অধিগ্রহণ : ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর।

২৭ : সেতু পাড়ে বৃক্ষরোপণ : লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪ লক্ষাধিক।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!