বাংলা ঋতুরাজ বসন্তের সমাপ্তির পরেই শুরু হয় নতুন বছর বৈশাখ মাস দিয়ে। এ বাংলা বর্ষ বরণে বৈশাখের প্রথম দিনেই মহা উৎসব আর আমেজে পালন করা হয় পহেলা বৈশাখ। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে বিভিন্ন প্রকার উৎসব ও পার্বণ। বাংলা নববর্ষের উদযাপন তেমনি বাঙালিদের একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব।
ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ পালন করে থাকে। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকাজুড়ে উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বাংলা বর্ষকে বরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহবানকে করে তোলে নয়নাভিরাম এবং গভীর আবেদনময়। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি.এস.সি এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।
বাঙালীদের বাংলার ইতিহ্য,কৃষ্টি-কালচারের চর্চার নানা প্রকার প্রতিকি প্রদর্শনের মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়। এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা,পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। আর এই বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল `শুভ নববর্ষ’। নববর্ষের এই দিনে সারাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক আনন্দ উদযাপনের মধ্য দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে `মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত মোঘল আমলে সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষের প্রচলন শুরু করেন। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার,তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। পর্যায়ক্রমে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
তৎকালীন বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিল। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে-বন্দরে ব্যবসায়ীরা বাংলা নববর্ষের শুরুতে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতেন। চিরাচরিতভাবে এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয় অনেক স্থানে।
বাংলা নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নিবীরভাবে জড়িত,ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত গ্রামীণ লোকজন নববর্ষ সাফল্যমন্ডিত করতে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। এমনকি এ দিনটি ভাল কাটলে তাদের সারা বছরেই ভাল কাটবে এমন ধারনা। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়,যা গ্রামাঞ্চলেরর মত শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত।
বাংলা নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়।
বৈশাখের বর্ষবরণ একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ধর্ম,বর্ণ নির্বীশেষে হাজারও মানুষকে একই কাতারে দাঁড়াতে সহায়তা করে। উজ্জীবিত হয় আমাদের মধ্যে বাঙালী মূল সংস্কৃতিবোধ। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য স্থানে এ ইতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়।
লেখকঃ মোঃ রায়হান আলী,আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট,খুলনা।