সরকার ভারত থেকে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিস্তার জন্য যেই চাপ দেওয়ার দরকার ছিল, সরকার তা করেনি। কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত করে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। সরকার ভারতের কাছ থেকে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করেছে।
আজ মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা বলেন।
আমি ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, উজাড় করে দিয়ে তো তিনি রেজাল্ট পাচ্ছেন। এবারো সব উজাড় করে দিয়ে এসেছেন, আবার রেজাল্ট পাবেন।
‘বেগম খালেদা জিয়ার কোনোভাবেই দেশের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই’ আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরে দেয়া। সেই কারণেই তাকে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে সাজা দেয়া হয়েছে। এটি একবারই মিথ্যা মামলা এর সাথে বেগম খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস। তখন ডাক্তাররা বলেছিলেন ‘লিভার ট্যান্সপ্লান্ট ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই’। যা বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যা করেছি আমরাই করেছি, পরিবার, দল করেছে। আমরা বিদেশ থেকে ডাক্তার নিয়ে এসেছি। এটা কোনো সমাধান নয়। একমাত্র সমাধান হচ্ছে, যেখানে তার সঠিক চিকিৎসা হবে সেখানে পাঠানো।
পরিবারে আবেদনক্রমে বেগম খালেদা জিয়াকে বাইরে পাঠানোর জন্য সকল ব্যবস্থা হয়েছিল- এমন তথ্য জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ফাইনালি এটি যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেছে, প্রধানমন্ত্রী তখন এটাকে রিজেক্ট করেছেন। শুধু এটাই নয়, বিভিন্ন মিশনগুলোকেও আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। তারা চেষ্টা করেছে। তারা বলেছেন, সরি। ‘উনি (প্রধানমন্ত্রী) শুনবেন না’।
এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) যাতে কোনোভাবেই মুক্তি না পান সেটি চলছে, এবার নির্বাচনে, ঠিক যেভাবে ’১৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠিয়েছে। ঠিক সেইভাবেই নির্বাচনের একমাস আগে থেকেই বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে, সেজন্য দুই দিনে ২৭ হাজার গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকার চায় না বিএনপি কোনো নির্বাচনে আসুক। সরকার জানে, বিএনপি নির্বাচনে আসলে তাদের জামানত থাকবে না।
বিএনপি সৃষ্টি হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এমন দাবি করে। মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে যা যা প্রয়োজন তাই তাই করবে। একটা কথা পরিষ্কার করে বলি, আমাদের বক্তব্য আন্দোলন কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নয়। এটি এই সরকারের বিরুদ্ধে। সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হচ্ছে ভারতের কাছ থেকে দাবিগুলোর আদায় করে নিয়ে আসতে। পানির হিস্যা আলোচনা না করেই চুক্তি করে যাচ্ছে।
বিএনপি ভারতের কাছে বিক্রি হয়েছে, সরকারের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা বিক্রি হলে তো সরকারেই থাকতাম। সরকার প্রধান তো আগেই বলেছেন, আমি ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। উজাড় করে দিয়ে তো উনি রেজাল্ট পাচ্ছেন। এবারো সব উজাড় করে দিয়ে এসেছেন, আবারো রেজাল্ট পাবেন।
উল্লেখ্য, গতকাল সোমবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে দলটি।
গতকাল রাত সাড়ে ৮টায় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, জনাব নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জনাব আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জনাব সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, জনাব ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
সভায় আলোচ্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে নিম্ন বর্ণিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
সভায় গত ৩ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে মহাসচিব জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভাকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে প্রিয় নেতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী গণতন্ত্রের আপোষহীন নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া’র রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হয়।
সভা মনে করে, গণতন্ত্র পুণূরুদ্ধারের জন্য দেশনেত্রীর অবদান, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে অতুলনীয়।
সভা আরো মনে করে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলায় সাজা প্রদান করে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে হীন চক্রান্ত করছে এই অবৈধ সরকার। সভা আরো মনে করে, শুধু মাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দেশনেত্রীকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং সংবিধান বিরোধী। এই মামলায় জামিন পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার। সভা মনে করে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন যাবৎ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন। চিকিৎসকেরা তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণের সুপারিশ করেছেন। দলের পক্ষ থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে প্রেরণের দাবি জানানো হয়েছে। এমন কি পরিবারের পক্ষ থেকে দুইবার তার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু অবৈধ সরকার তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে দেশনেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্ছিত করেছে। সভায় অনতিবিলম্বে দেশনেত্রীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। সভায় দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই র প্রয়োজনীয় কর্মসূচী প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সভায়, সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফরে দেশটির সাথে দু’টি চুক্তি, পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্বারক ও তিনটি চুক্তি নবায়নসহ ১০টি চুক্তি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায়, সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টনের কোনো চুক্তি না করা, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা বন্ধ না করা, একতরফাভাবে ভারতকে সকল সুবিধা প্রদান করে বাংলাদেশের স্বার্থ ব্যাপকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছ। কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত রেল যোগাযোগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগের সমঝোতা, কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা, ওষুধ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতের অবাধ বিচরণ এবং ভারতের ইনস্পেস ও বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা, রেলমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা, সমুদ্র বিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতা ইত্যাদি সমঝোতাগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে। ভারতকে সকল প্রকার সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে ভারতের কাছে থেকে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ আদায় করতে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন এবং এটা ম্যান্ডেটবিহীন অবৈধ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বহিঃপ্রকাশ। এই অবৈধ সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলছে।
সভায়, এই চুক্তিগুলোকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হওয়ায় বিএনপি এই চুক্তিগুলো প্রত্যাক্ষাণ করছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত সংবাদ সম্মেলন আগামী ২৮ জুন বিকেল ৩টা অনুষ্ঠিত হবে।
সভায়, সম্প্রতি মিয়ানমার কর্তৃক বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত জলসীমায় নির্বিচারে গুলি বর্ষণের ফলে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেন্টমার্টিনের যোগযোগ বন্ধ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে, এই অবৈধ সরকারের নতজানু পরারষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বার বার হুমকির সম্মুখিন হচ্ছে। এই বিষয়ে অবৈধ সরকার জনগণকে সুস্পষ্টভাবে কোনো তথ্য সরবরাহ করছে না। সভা অনতিবিলম্বে মিয়ানমার কর্তৃক বাংলাদেশের সীমান্তে গুলিবর্ষণ বিষয়ে জনগণের নিকট ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানায়।
সভায়, বৃহত্তর সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে, কিশোরগঞ্জে হাওড়ের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ এবং বেশ কিছু এলাকায় মাটি ভরাট করে কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করায় ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানি দ্রুত নিষ্কাশিত না হওয়ার কারণে এই ভয়াবহ দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরসহ বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানির তলে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষ সীমাহীন দূদর্শার মধ্যে পড়েছে। দূর্গত এলাকায় সরকারের কোনো ত্রাণ তৎপরতা দেখা যায়নি। অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের জন্য সভায় দাবি জানানো হয়। বিএনপির একটি ত্রাণ টিম অতিদ্রুত সিলেট সফর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সভায়, গত এক মাসে ওষুধের মূল্য ১০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি এবং সেইসাথে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সভায়, এই মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণের যে দুর্ভোগের জন্য সরকারের দুর্নীতি ও ভ্রান্তনীতিকে দায়ী করা হয়। অবিলম্বে ওষুধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদির মূল্য হ্রাসের জোর দাবি জানানো হয়।
খুলনা গেজেট/এনএম