বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমীমাংসিত বিষয় হলো তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দুদেশের মধ্যে চুক্তির কথা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু আশ্বাসেই থেমে আছে তিস্তা ইস্যু। এদিকে এই ইস্যুর মধ্যেই তিস্তা নদীতে বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের জন্য তৎপর চীন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এই প্রকল্পটির ব্যাপারে আবারো আগ্রহ প্রকাশ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে এক বৈঠকে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশ সম্মতি দিলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে চীন তৈরি আছে। এছাড়া বাংলাদেশের দিক থেকে প্রকল্পের প্রস্তাব পেলে চীন সহযোগিতা দেবে।
তবে তিস্তা নদীর ওপর এ প্রকল্প নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে ভারত এবং চীন। ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সাথে এ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারছে না বলে ধারণা করছে পর্যবেক্ষকরা। তাদের ধারণা, তিস্তা নিয়ে চীনের আগ্রহ মূলত কৌশলগত। চীন এ প্রকল্পটিকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রজেক্টের কারণে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহী অনেক বেশি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে একই রাস্তায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। দেশটির বিআরআই প্রকল্পের আওতাধীন বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ গৌণ এবং তাদের কোনো ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এখানে জড়িত নেই। তিনি বলেন, তিস্তা নদীতে এই প্রকল্পটি শুধু বাংলাদেশেরই। এটি চীনের কোনো প্রকল্প নয়। এই প্রকল্পের জন্য চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজী হয়েছে। কারণ অন্যরা সেই অর্থ দিতে পারছে না।
এদিকে ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী বলেন, তিস্তা প্রকল্পের যে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবে না। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন সব প্রকল্প নিয়ে চীন ‘অতিরিক্ত আগ্রহ’ প্রকাশ করে। চীন চায় তাদের উপস্থিতি জোরালো করতে।
ভারতের আপত্তিতে আটকে থাকা তিস্তা প্রকল্পে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এরকম একটা প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা ভালো। সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উপর চাপ বজায় রাখতে পারে। এছাড়া তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে গেলে বাংলাদেশের উপর ভারতের যে প্রভাব, সেটা আর থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই পাশে শহর গড়ে উঠবে, নদী শাসন হবে এবং নদীর নাব্যতা থাকবে। ফলে পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং দুই কোটি মানুষের জীবনও বদলে যাবে। এর ফলে সেখানে চীনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির পাশাপাশি ভারত-বিরোধী মনোভাব আরও প্রবল হবে।
জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পের আওতায় আছে- নদী খনন করে গভীরতা বাড়ানো, সারা বছর নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করা, নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ।