দিনটি রবিবার। ২৩ এপ্রিল, ২০২৩। সকাল ৯টা। খুলনা-কলকাতা চলাচলকারী বন্ধন ট্রেনটি ভারতের পেট্রাপোল স্টেশন পার করে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করছে। সামান্য পরেই খুবই ধীরে চলা ট্রেনটি থেমে যায়। আমি যে কোচটিতে ছিলাম তাতে হুড়মুড় করে, চিৎকার করতে করতে দশ-বারো জন যুবক প্রবেশ করে। তার আগে থেকেই যাত্রীদের একাংশের মধ্যে তাদের মালপত্র নিয়ে এক ধরনের চাঞ্চল্য চোখে পড়েছিল। বাঙ্কার থেকে কেউ কেউ লাগেজ নামাচ্ছিলেন। ওই যুবকরা প্রবেশ করতেই লাগেজ নামানোর গতি বেড়ে যায়। শুরু হয় অদ্ভূত রকমের এক ব্যস্ততা।
নানা রকমের কথাবার্তার আওয়াজ। কেউ কেউ বলছিলেন, ‘এই লাফ দিয়েছে’, ’পড়ে গেছে’; ‘পুলিশ/বিজিবি ধাওয়া করেছে’, ‘ধরা খেল’, ইত্যাদি ইত্যাদি। কৌতুহল দমন করতে না পেরে নিজেও বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি। এরই মধ্যে কোচের পশ্চিম প্রান্তের গেটের কাছে মারামারি শুরু হয়ে গেল। একাধিক জনের চিৎকার। ওই আচমকা ওঠা আরোহীদের মধ্যেই বিবাদ! মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাঙ্কারে থাকা লাগেজগুলোর প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ খালি হয়ে গেল, নতুন আরোহীরা নেমে পড়লো। ট্রেন আবারও ধীরে এগুতে শুরু করে। থামে বেনাপোল স্টেশনে।
একি! ট্রেন থেকে যাত্রী নামাতো দূরের কথা, উঠছে। একাধিক ধরণের ইউনিফর্ম পরা মানুষ, কেতা-দূরস্ত পোষাকপরা মানুষও উঠছে। যাত্রীদের একাংশও কোচের মধ্যে রীতিমত দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। কয়েক মিনিট পরে আমি আমার ট্রলি-ব্যাগটি নিয়ে ধীরে ধীরে নামি। স্টেশনে তখন বিস্ময়কর-রকম ব্যস্ততা। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ ধাওয়া করছে, কেউ কারও লাগেজ ধরে টানছে, লাগেজ টানাটানিকারীদের মধ্যে বাদানুবাদ, চিৎকারতো আছেই। আমি ভাবি, এটি কি আন্ত:রাষ্ট্রীয় একটি ট্রেন-সেবা! ইমিগ্রেশন পর্ব নির্বিঘ্নে শেষ হয়, যদিও যাওয়ার দিনে অভিজ্ঞতাটি সুখকর ছিল না। সেদিন নানা ত্রুটির অজুহাতে নানান জনের নিকট হতে টাকা নেওয়ার অভিযোগ শুনি। একজন বেসরকারী চাকুরিজীবীর কাছে প্রতিষ্ঠানের ছুটির কাগজ ছিল না, তাই তাকে তিনশ’ টাকা দিয়ে নিস্তার পেতে হয়েছে।
পরিচিত একজন সহ-যাত্রী অবশ্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো পর্বে বলেছিলেন, কমপক্ষে একশ’ টাকা করে না দিলে কেউই পার পাবে না। অবশ্য তাঁর আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বলে আমি এলাম। তা না হলে চারশ’ টাকা দিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে দিলেই ওরা ইমগ্রেশন শেষ করে পাসপোর্ট দিয়ে দিতো।’
আমি বলি, ‘কাস্টম চেকিং?’ ব্যাঙ্গের হাসি হেসে তিনি বলেন, ‘হা হা স্কানার মেশিন নষ্ট দীর্ঘদিন। আর ওই যে চারশ’ টাকা।’ ফেরার পর্বে সেটি না ঘটলেও বিশৃঙ্খলা ছিল অন্যত্র। কাস্টমস পর্ব পার করার জন্যে এগুতেই কক্ষটি কলাপসিবল গেট দিয়ে আটকানো দেখি। যাত্রীরা সব সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে শুরু করে। ভিড় বাড়তে থাকে। কিন্তু সামনের কক্ষে কাস্টমস কর্মকর্তারা আর আসেন না। একজন এলেন, ঘুরে দেখে চলে গেলেন; তিনি পরে এসে সারি সারি চেয়ার টেবিলের একটিতে বসলেন। বেশ খানিক পরে একজন ইউনিফর্মধারী কাস্টমস কর্মকর্তা হাতে লাগেজ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন। তাই দেখে আমার পিছনে দাঁড়ানো এক যাত্রী বলে উঠলেন, ‘ওর পেট অনেক মোটা, ওর পেট মোটে ভরে না, ওর বাড়িতে সবাই না খেয়ে থাকে।’ আমি পিছনে তাকিয়ে জানতে চাই, কে তিনি। বিরক্তিভরা কণ্ঠে জানান, ‘দেখছেন না, কাস্টমস-এর পোষাক-পরা লোক। লোকের জিনিসপত্র ট্রেনে উঠে নিয়ে আসে। টাকা দিলি পাওয়া যায়, তা নাহলে ওই মাল নিয়ে নেয়।’ কাস্টমস-এর দায়িত্বপালনকারী প্রায় সকল কর্মকর্তাই এভাবে ট্রেনের কোচে উঠে মালামাল নিয়ে আসেন।
এক সময়ে কলাপসিবল গেট খুললো। লাগেজ চেকিং অকেজো স্কানার মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে অলস অবস্থায় শোভা- বর্ধন করছে। একজন ছুটে এসে আমার ট্রলি-ব্যাগটি উঁচু করে কি যেন বুঝার চেষ্টা করলেন। সেটি রেখে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখালেন। বেরুনোর পথটিরও কলাপসিবল গেট যথারীতি আটকানো। বাইরে অপেক্ষমান বিজিবি সদস্যরা। একজনকে বলতে শুনলাম, ‘স্যার না আসলে গেট খোলা হবে না।’ কিছু পরে গেট খোলা হ’ল। যাত্রীরা বেরুতে শুরু করলো।
একজনের লাগেজ টেনে এক বিজিবি সদস্য বললেন, ‘এদিকে আসেন।’ কাউকে উদ্দেশ্য করে আর একজন বিজিবি সদস্য বলছেন, ‘এই, এই যে আপনি, এদিকে আসেন।’ এরই মাঝে আমি ধীর পায়ে প্লাটফর্মের দিকে এগুতে থাকি। ভাবছিলাম, কাস্টমস-এর মূল কাজটি হচ্ছে, যাত্রীদের জিনিসপত্র চেক করা। কেউ কোন বেআইনি জিনিসপত্র আনছে কি-না বা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মালামাল আনলে তা নজরে এনে শুল্ক আদায় করা। আর বে-আইনি কিছু ঘটলে আইনের হাতে সোপর্দ করা। কিন্তু এ কি বিশৃঙ্খলা! চোর-পুলিশ খেলা। লাগেজ নিয়ে পালানোর চেষ্টা, তাই ধরার চেষ্টা, আটকানো এবং টাকা আদায় করা। ট্রেনের নির্দিষ্ট কোচের নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসি।
এক সময়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। দেখি, কোচটিতে যে যাত্রী ছিল, তার ষাট শতাংশের মত যাত্রী নেই। উপরের বাঙ্কারগুলোও প্রায় ফাঁকা, — মালামাল, লাগেজ নেই। আমার সিটটি বিপরীতমুখী (ট্রেন যাওয়ার বিপরীতে) হওয়ায় নজরে এলো স্টেশনের প্লাটফর্মে একজন বয়স্ক নারী-যাত্রীর একটি ব্যাগ নিয়ে একজন বিজিবি সদস্য টানছেন, আরও কয়েকজন তাঁকে ঘিরে আছেন; কাঁচের জানালায় আটকানো সিটে বসেই বুঝতে পারলাম ওই নারী চিৎকার করছেন। ট্রেন খুলনামুখো ছুটতে শুরু করলো। কোচের মধ্যে দেখি চার-পাঁচ জন পুলিশ ধীর-লয়ে পায়চারি করছেন। একজন একটি ব্যাগ দেখিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এটি কার’?? কেউ একজন সাড়া দিল, আগের কণ্ঠটি আবারও বলে উঠলো, ;ওটি খুলে দেখান।’
বাহ্, এটাই আন্ত:রাষ্ট্রীয় ট্রেন-সেবা! খুলনা-বেনাপোল কমিউটার ট্রেন-সার্ভিসটি লাগেজ পার্টির জন্যে রমরমা বলে একটি কথা চালু ছিল/আছে; বুঝা গেল বন্ধনেও লাগেজ পার্টির সক্রিয়তা বেড়েছে; আর সকলেরই জ্ঞাতসারে এবং সকল পক্ষই লাভ করার আশায় ছুটছে; আর উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, হুড়োহুড়ি, সাধারণ যাত্রী হয়রানি; যা ট্রেনসেবাকে ঘিরে আমাদের মান-নৈতিকতার অবনমন ঘটছে!! (ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম