খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

বঙ্গবন্ধু কন্যা ছাড়া আর কারও পক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব ছিলো না

প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন

স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। তাও আবার নিজস্ব অর্থায়নে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে পদ্মা সেতু একদিকে বৃহৎ প্রকল্প, অন্যদিকে তা ছিলো অত্যন্ত জটিল। সে অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিলো স্বপ্নের মতো। রূপকথার গল্পের মতো। এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। কারণ, তাঁর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা ছাড়া এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো না। দৃঢ়ভাবে আজ এ কথা বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও পক্ষে দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব ছিলো না। এজন্য আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

যাহোক দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। এ দিনটি বাঙালি জাতির জন্য উৎসব ও প্রেরণার। একই সাথে তা প্রেরণার এক উৎস। পদ্মা সেতু এখন আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। বাংলাদেশ যে ‘পারে’, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে তা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে বলতে পারছি যে, ‘আমরাও পারি’। পদ্মা সেতু আমাদের মনোবল ও সাহস যোগাচ্ছে। অদম্য মানসিক দৃঢ়তা এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমরা মনে করি, আমাদের কোনো কিছুতেই আর দাবায়ে রাখা যাবে না। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। এটা আরেক নিদর্শন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা সবাই মনে করছি যে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর অবকাঠামো উন্নয়নের আমাদের একটা বিশাল অর্জন হয়েছে, যা ছিলো স্বপ্ন, তা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এটা যুগান্তকারী অর্জন। পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্য আজ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সক্ষমতার বার্তা জানান দিচ্ছে।

আমরা খুব ভালো করে জানি যে দীর্ঘদিন ধরে এই দক্ষিণাঞ্চল প্রায় সকল উন্নয়ন ক্ষেত্রে অবহেলিত ছিলো। রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকাটাই তার মূল কারণ। আর শুধু সরাসরি যোগাযোগের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের এ বিশাল ভূ-খন্ড নানাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এ অঞ্চল থেকে মানুষ কোনো প্রয়োজনে ঢাকা যেতে ৮-১০ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ব্যয় করেছে। নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেছে। আর ঈদের মতো উৎসব সামনে রেখে যাতায়াতের যে কী দুর্ভোগ হয় সে চিত্র আমরা দেখে আসতে অভ্যস্ত। কিন্তু, সুদীর্ঘকাল এই দুর্ভোগ লাঘবে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। আজ পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যেমন দুর্ভোগ লাঘব করবে, তেমনি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোর বা পটুয়াখালী-বরিশাল-বরগুনা এখন মাত্র চার ঘণ্টায় যাতায়াতে সম্ভব হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির সুফল পাবেন কৃষক সমাজ। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য অল্প সময়ে রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে একসময় শিল্পায়নের যে গতি ছিলো, নানা কারণে তা স্থবির হয়ে পড়ে। এখন সেই গতি আবারও ফিরে আসবে বলে আশা করছি।

পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় মংলা বন্দর বহুগুণে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক শিল্পায়নের যে প্রক্রিয়া চলছে এবং এ বন্দরের উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, এর ওপর পদ্মা সেতু সরাসরি প্রভাব রাখবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর পরোক্ষ ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে নানা ক্ষেত্রে। অন্তত পক্ষে ১৫-২০ ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব পড়বে। এছাড়া পরোক্ষ প্রভাবের হিসেব করে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, তথ্য-প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের ওপর।

পদ্মা সেতু ১% থেকে ২% পর্যন্ত আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে বলে অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাসবতবে এর চেয়ে আরও প্রভাব পড়তে পারে যা আমরা এখনও অনুধাবন করতে পারছি না। কারণ, এ অঞ্চলে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে। এই অঞ্চলে যখন শিল্পায়ন হবে, সেই শিল্পায়নের একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দেশের উপকূলীয় এলাকা। উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সেই উন্নয়নের রোডম্যাপে আমরাও কিন্তু যুক্ত হয়েছি। পদ্মা সেতু আমাদের মোংলা পোর্ট এবং এই অঞ্চলের শিল্পায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমি মনে করি যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ খুলনা অঞ্চলে অন্যান্য যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তার জন্য কিন্তু নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এখন আমরা ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনে আমাদের যে দক্ষ জনশক্তি দরকার তা গড়ার ভূমিকা তা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নিতে হবে। এই পদ্মা সেতুকে আমরা সামনে ধরে রেখে আমাদের যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যেটা শুরু হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে যেনো আমরা চলতে পারি। সেজন্য আমাদেরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী কোয়ালিটি এডুকেশন দিতে হবে, যেগুলো আসলেই শিল্পায়ন এবং বিশ্বায়নের যুগে যেনো যথাযথভাবে কাজ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লিংক স্থাপন করতে হবে।

পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটনের ক্ষেত্রে অন্যতম সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। এখানে সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, যার প্রতি বিশ্ব আকৃষ্ট এবং এটা ন্যাচারাল হেরিটেজ সাইট, সেই অনুযায়ী এখানে পর্যটকরা আসছেন ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি নয়, যতটা আমরা আশা করছি। এর অন্যতম কারণও কিন্তু এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। পদ্মা সেতু চালু হলে সুন্দরবনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে এবং মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি সড়ক পথে পশ্চিম অংশেরও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হবে। এছাড়া গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট থেকে মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলা পর্যন্ত সুন্দরবনের যে পূর্ব অংশ সেখানেও কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। এর ফলে পর্যটন শিল্পে একটা অবারিত সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা।

পদ্মা সেতু চালু হলে পর্যটক অবশ্যই আসবে। পাশাপাশি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং তার যে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য, তার যে ইকোলজিক্যাল সার্ভিসগুলো রয়েছে, এই অধিক ও অপরিকল্পিত পর্যটকের কারণে সেগুলোর যেনো ক্ষতির কারণ না হয়। সেজন্য পর্যটককে অবশ্যই আমরা আহ্বান জানাবো, পাশাপাশি যথাযথ পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবকাঠামোগত এবং আইনগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সরকার তা নিয়ে ভাববে। মাস ট্যুরিজম না করে কনট্রোল ইকোট্যুরিজমের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ফলে আমাদের সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল যে জনগোষ্ঠী রয়েছে তারাও উপকৃত হবে। এই ইকোট্যুরিজমে তারাও নানাভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবে।

পর্যটক যখন কোনো এলকায় আসে, তখন সে চিন্তা করে যে আমি কতগুলো নিদর্শন দেখতে পারবো। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে শুধু সুন্দরবন নয়, সুন্দরবনের আশেপাশে আরও অনেক পর্যটন স্থান রয়েছে। বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ রয়েছে, পীর খানজাহান আলী (রহ.) এর মাজার রয়েছে, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ, খুলনার দক্ষিণডিহি রয়েছে। অপরদিকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রয়েছে। আশা করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে পদ্মা সেতু এই অঞ্চল, এই পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষেরও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্যখাতে কিন্তু একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে সহজে মানুষ ঢাকায় যেতে পারবে। আবার ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা খুলনায় এসে চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন। পদ্মা সেতুর কারণে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে।

স্যার কথায় বলতে গেলে, পদ্মা সেতু দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন ভূ-খন্ড এনে দিয়েছেন। আর তাঁরই রক্তের উত্তরসূরি, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন মাইলফলক। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অন্যরকম এক বিজয় উদযাপন করবে যা হবে দেশ ও জাতির জন্য নতুন প্রেরণার উৎস। পদ্মা সেতু নির্মাণের এই সাফল্য, আর সেই সাথে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুকীর্তি অনাগত কাল ধরে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

(লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

 

 

খুলনা গেজেট/ আ হ আ




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!