বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তার জীবনের নানান গল্প নিয়ে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর স্থাপন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ এই দুই ধরনের দুটি কোচে এই জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে।
আগামী বুধবার (২৭ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রেল কোচে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর তৈরির এ উদ্যোগ নেওয়া হয় গত বছর। ১৯২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ও বেদনাবিধুর ঘটনার দিন পর্যন্ত নানা চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘরে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, তার শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে ছাত্র রাজনীতি, ১৯৫৪ এর নির্বাচন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, সর্বোপরি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সাড়া জাগানো কাব্যিক ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া থেকে শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তার ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠা-এর সবই তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে।
দৃষ্টিনন্দন ইন্টিরিয়রের মাধ্যমে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ এর দুটি কোচের ভেতর সাজানো হয়েছে। প্রত্যেক কোচের ভেতরে মধ্যের অংশ খালি রেখে চারপাশ সাজানো হয়েছে সাদাকালো ও রঙ্গিন ছবিতে।
নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী এবং প্রত্যন্ত জনপদের সাধারণ মানুষ যেন সহজেই খুব স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করতে পারেন তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
ভ্রাম্যমাণ এই রেলওয়ে জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে দুই পাশের চারটি দরজা দিয়েই। তবে যে পাশে প্লাটফর্ম থাকবে সেই পাশের দরজা দুটিই শুধু খোলা থাকবে।
ভিতরে ঢুকে প্রথমেই দর্শনার্থীরা দেখতে পাবেন ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল সেই গ্রামের চিত্র। এই অংশে ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত একে একে তুলে ধরা হয়েছে তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনকাল।
এরপর আছে ১৯৪৩ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার জীবনের নানা ঘটনার স্থির চিত্র। আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সালকে। বড় ফ্রেমে বাঁধাই করা এসব স্থির চিত্র একেবারেই দৃষ্টিনন্দন।
১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল, ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সালের গণঅভূত্থান ও নির্বাচনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৭ মার্চের ভাষণ, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণ, তার শাসনামল তুলে ধরা হয়েছে পৃথক পৃথক চিত্রে।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের পর টুঙ্গিপাড়ায় গড়ে উঠা বঙ্গবন্ধুর মাজারের একটি স্থির চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জীবনের অধ্যায়।
রেলওয়ে জাদুঘরের প্রতিটি স্থির চিত্রের নিচে লেখা রয়েছে বঙ্গবন্ধু কখন কার কার সঙ্গে কোথায় কি কাজ করেছেন, কোন কোন আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। আছে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ ছবি। প্রতিটি চিত্রে ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান জীবন বৃত্তান্ত।
এই জাদুঘরে রয়েছে একটি ছোট বুক কর্ণার। যেখানে বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচাসহ বিভিন্ন বই ও প্রকাশনা। আছে বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখার কিছু পোট্রেট। এ ছাড়া ৭ মার্চের ভাষণের ভিজ্যুয়ালও রয়েছে।
এই জাদুঘর সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গত রবিবার (২৪ এপ্রিল) ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের অনেকগুলো কর্মসূচীর মধ্যে এই ভ্রাম্যমান রেলওয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে অন্যতম। আমরা চেয়েছি বঙ্গবন্ধুকে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিতে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই জাদুঘরটা হচ্ছে স্থায়ী একটা কাজ। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দু্টি কোচে আমরা এই জাদুঘর তৈরি করেছি। সারাদেশের প্রতিটি স্টেশনে এই জাদুঘর নিয়ে যাওয়া হবে। সেসব স্টেশনে রেখে প্রচারণা চালানো হবে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোররা এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ এই জাদুঘর বিনা পয়সায় দর্শন করে বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবেন। এটিই হচ্ছে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য।
রেলপথমন্ত্রী জানান, এটি মুজিববর্ষে তৈরি করা হলেও কোভিডের অভিঘাতের কারণে আমরা সেটি উদ্বোধন এবং চালু করতে পারিনি। আগামী ২৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রেলওয়ের এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর উদ্বোধন করার জন্য সম্মতি দিয়েছেন। আশা করছি ওই দিন থেকেই এই জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হবে।
এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে যেসব কাজ হয়েছে সেগুলোর সবই ক্ষণস্থায়ী, মুজিববর্ষ শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবই শেষ হয়ে যাবে। তখনই আমার মাথায় একটা চিন্তা এলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোনো কাজ করা যায় কি না। এরই অংশ হিসেবে আমাদের রেলওয়ের এই ব্যতিক্রমী চিন্তা। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে জাদুঘর করা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৮০ শতাংশ স্টেশন হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমরা যদি এই জাদুঘর সেই স্টেশনগুলোতে নিয়ে যেতে পারি তাহলে প্রান্তিক মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনী অনেক সুন্দর ও সহজভাবে উপস্থাপন করা যাবে। সাধারণত আমরা শহরকেন্দ্রিক আলোচনা বেশি করে থাকি। আয়োজনও সেরকমই হয়ে থাকে।
রেলওয়ের একই কর্মকর্তা বলেন, এসব চিন্তা থেকেই রেলপথ মন্ত্রীর সক্রিয় সহযোগিতা এবং নির্দেশনায় আমরা রেলপথ জাদুঘর গড়ে তোলার কাজ শুরু করি। প্রায় এক বছর সময় নিয়ে করোনাকালীন সময়ে আমরা এই জাদুঘর তৈরির কাজ করি রেলওয়ের দুটি কোচে।
এই জাদুঘরে ১২টি এলইডি আছে। সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ এবং অডিও, ভিজ্যুয়াল এবং স্থির চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী জানান, জাদুঘর দেখতে আসা দর্শকরা যেমন স্থির চিত্র দেখতে পাবেন, তেমনি কানে হেডফোন লাগিয়ে অডিও-ভিজ্যুয়াল শুনতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোট, চশমা, পাইপ এগুলোর রেপ্লিকাও আমরা তৈরি করে জাদুঘরে স্থান দিয়েছি। একইভাবে শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং বঙ্গবন্ধুর মাজারের রেপ্লিকাও রাখা হয়েছে।
একটি বড় এলইডিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ অন্যান্য ভাষণও এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর মানুষের কাছে স্বল্প পরিসরে চিত্তাকর্ষকভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন তুলে ধরতে সম্ভব হবে। দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে পৌঁছে দিতে একটা বিশেষ ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ রেলওয়ের এই উদ্যোগ।
তিনি আরও জানান, আমরা এই দুটি কোচের বাহিরের অংশ সাজিয়েছি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যেসব ধারাবাহিক ঘটনা রয়েছে সেগুলোর ম্যুরাল দিয়ে।
তিনি বলেন, মুজিববর্ষ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের এই চেষ্টা বছরের পর বছর দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াবে। বিভিন্ন স্টেশনে প্রচারণা চালাবে।