ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহিব উল্যার মানুষের জমিতে খেটে যা পান, তা দিয়েই সংসার চলে। বন্যায় তাঁর ঘুণে ধরা বেড়ার ঘরটি ভেঙে গেছে। শৌচাগার, রান্নাঘরও তলিয়ে গেছে। পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছেন ফেনী শহরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘এত বড় বন্যা হবে, তা কখনও ভাবিনি; প্রস্তুতও ছিলাম না।’ ফেনী শহরের বাসিন্দা মো. ইব্রাহীম জানান, তিন উপজেলার পর ফেনী শহরও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের বাসার নিচতলায় পানি ঢুকে যাওয়ায় ফকিরাহাট এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে ফেনী শহরের স্টেশন রোডের একটি হোটেলে উঠেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।
ফেনীর তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর লড়াই চলছে। ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট ও আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ, পৌর শহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যার পানিতে থইথই।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বলেন, ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এ ছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞার অনেক এলাকাও বন্যাকবলিত। পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ফেনীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উঁচু ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ফেনীর বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। সেখানে ৪০টি উদ্ধারকারী যান নিয়ে গেছেন ১৬০ সেনাসদস্য। স্থাপন করা হয়েছে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। কাজ করছে নৌবাহিনীর ৭১ সদস্য এবং আটটি উদ্ধারকারী যান। বিজিবিসহ অন্যদের নৌযান সেখানে নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, জুলাইয়ে শুরুতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়ে ১৫ স্থানে ভাঙে। সেসব স্থানে জোড়াতালি মেরামতের পর এ মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১১ স্থানে ভেঙে গিয়ে প্লাবিত হয় ১০০টির বেশি গ্রাম। যেখানে অবকাঠামো, ধান, ফসল ও মাছের ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ৩০ কোটি টাকার বেশি। সেই ক্ষত না শুকাতেই ১৫ দিনের মাথায় আবার বন্যা। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীন আক্তার বলেন, পরিস্থিতি এত দ্রুত খারাপ হয়েছে, আমাদের সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
গতকাল দুপুরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে দল বেঁধে আশ্রয়ের খোঁজে আসেন অনেকে। সঙ্গে তারা নিয়ে আসেন চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, শুকনা খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। কথা হয় চৌমুহনীর করিমপুর এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমানের সঙ্গে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি আশ্রয় নিতে এসেছেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বলেন, বাড়ির উঠানে কোমরপানি, ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই, তাই বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হাই স্কুলের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছি। একই এলাকার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের সড়কের হাঁটুপানি মাড়িয়ে সামনে এগোতে দেখা যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব মোহাম্মদ হারুনকে। তিনি বলেন, বসতঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। ঘরে বৃদ্ধ মা, তিন ভাইবোন ও স্ত্রী রয়েছেন। তাদের নিয়ে কোথাও যাব, সে উপায় নেই। ঘরের খাবারও ফুরিয়ে এসেছে। তাই খাবারের সন্ধানে ঘর থেকে বেরিয়েছি।
বেগমগঞ্জ পার হয়ে সেনবাগের দিকে যেতেই চোখে পড়ে বন্যার অভিন্ন ছবি। সেনবাগের এমপি রোডের মাথায় (হজনী খাল) দেখা যায়, নারী-শিশুসহ একটি পরিবারের সদস্যরা গাড়ির অপেক্ষায় আছেন। বেগমগঞ্জের শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা এই পরিবার সেনবাগ উপজেলা সদরে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। গৃহকর্ত্রী জয়নব বেগম জানান, তাদের বাড়িঘর সবটাই পানি নিচে।
এদিকে ঢলের পানিতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জে ১০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে শত শত মাছের ঘের, আউশ ধান ও আমনের বীজতলা। এ ছাড়া আদর্শ সদর, লাকসাম, বুড়িচং, বরুড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও দাউদকান্দির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার নদীর চরতীরবর্তী শাকসবজির ক্ষেতসহ ফসল তলিয়ে গেছে। কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলা নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রামের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কুমিল্লার রুদ্র রূপ ধারণ করেছে গোমতী নদী। ২৭ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে গোমতীর পানি গতকাল বিকেলে বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে গোমতীর উভয় তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে। গোমতী ছাড়াও ডাকাতিয়া, কাকড়ী ও গুঙ্গুর নদীর পানিতেও পানি বেড়েছে। জেলায় ৫৮৭ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তিতাস উপজেলায় গোমতীর পানি বেড়ে বাঁধ ডুবে গেছে। ভেঙে গেছে আসমানিয়া বাজারসংলগ্ন একটি অস্থায়ী সেতু।
নাঙ্গলকোট উপজেলার কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, তিন দিন ধরে পানিবন্দি। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে পানি উঠেছে। প্রবল স্রোতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত কাঠের তৈরি সেতুটি ভেঙে গেছে। এতে ৪৩ গ্রামের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চান্দিশকরা এলাকার আহমেদুল হক জানান, গেল ৪০ বছরেও এমন পানি দেখেননি। পুকুর-বীজতলা সব পানিতে তলিয়ে গেছে। মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও এলাকার বাসিন্দা নূর হোসেন বলেন, ‘আমাদের অবস্থা ভয়াবহ। আজ কোনোরকম খেয়েছি। আগামীকাল কী হবে, কিছুই বুঝতেছি না।’