এক মাস ধরে রেললাইনের মতো সমান্তরালে চলছে বটে ইউরো আর কোপা আমেরিকা; তবে সেখানে সম্প্রচারের সৌন্দর্যে, উত্তেজনায়, মাঠের অবস্থায়, রেফারিংয়ের মানে, সময়ের পার্থক্যে, দর্শক আগ্রহে…সম্ভবত এমন কোনো দিক নেই, যেখানে ইউরোর কাছে লাতিন আমেরিকান ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্টটি মার খায়নি। কিন্তু শেষবেলায় এসে হিসাবে ১৮০ ডিগ্রি বদল!
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বিশ্বের কাছে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের বিজ্ঞাপন হওয়ার মতো ম্যাচ তো এই একটাই আছে, বাংলাদেশ সময় আগামীকাল ভোর ছয়টায় ফাইনালে সেটির মঞ্চায়ন যখন হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি আকর্ষণ জাগানিয়া কোনো বিজ্ঞাপন সম্ভবত হতে পারত না।
ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা! মেসি বনাম নেইমার! রাত পোহালেই ধ্রুপদি মহারণ।
লড়াইয়ের মঞ্চটাও দেখুন, ব্রাজিলের ফুটবলতীর্থ মারাকানা স্টেডিয়াম! তার ওপর এটি হতে যাচ্ছে মেসি কিংবা নেইমারের কোনো একজনের জাতীয় দলের হয়ে বড় কোনো শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ ঘোচানোর ঐতিহাসিক ম্যাচ।
নাহ, ইউরোতে ইংল্যান্ড-ইতালি ফাইনালকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিনীত নিবেদন এই যে এর চেয়ে বড় কোনো উপলক্ষ আর হতে পারত না!
এর চেয়ে বড় যদি কিছু হতে পারে, তবে সেটি হচ্ছে একটা প্রশ্ন—কে জিতবে? ঝামেলাটা হলো, প্রশ্নটাকে ঘিরে পূর্বানুমান-ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে, বিশ্লেষণ চলতে পারে, কিন্তু সরাসরি প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য কারও নেই। তার চেয়ে বরং সম্পূরক প্রশ্নটা নিয়েই আলোচনা চলতে পারে, সেটিও চায়ের টেবিলে কম ঝড় তুলবে না। প্রশ্নটা এই—কে হবেন এবারের কোপা আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়? মেসি না নেইমার?
দুই দলের সমর্থকদের হয়তো প্রশ্নটার উত্তর দিতে চোখের পলক ফেলার সময়ও লাগবে না। সেরা খেলোয়াড় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে টুর্নামেন্টের নির্বাচক কমিটির কাজটাও এবার এক দিক থেকে বেশ সহজ। মেসি-নেইমারের বাইরে কারও নাম বিবেচনায়ই নিতে হবে না! আবার হয়তো শুধু দুজনের মধ্যে বেছে নিতে হবে বলেই কাজটা সবচেয়ে কঠিন। এ যে হৃৎপিণ্ডের দুই অলিন্দের কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার মতো!
মেসি আর নেইমার তো এবারের কোপা আমেরিকার হৃৎপিণ্ডই! যাঁদের কারণে ইউরোর ডামাডোলের মধ্যেও বিশ্ব ফুটবলে গুরুত্বের বিচারে কোপা আমেরিকা ‘আফ্রিকান কাপ অব নেশনস’ কিংবা ‘কনক্যাকাফ গোল্ড কাপ’ হয়ে যায়নি। নামের ভার তো ছিলই, ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে উঠতে বাধ্য করেছে তা, টুর্নামেন্টজুড়ে মেসি-নেইমারের ফুটবলের ধারও ঢুলুঢুলু চোখের পলক আটকে দিয়েছে বারবার।
কী করেছেন দুজন, তার হিসাবে না গিয়ে বরং অন্যভাবে বললে একবাক্যে সবকিছু বলা হয়ে যায়—কী করেননি দুজন! দলকে ফাইনালে তুলেছেন, সে পথে মাঝেমধ্যে কুংফু-কুস্তির ভ্রমে ফেলে দেওয়া কোপা আমেরিকায় নৈসর্গিকতার উপাদান হয়ে ছিল তাঁদের দুই জোড়া বুট। একদিকে মেসির ৩৪ বছর বয়সী পা জোড়ার উপহার হয়ে এসেছে তিনজন কলম্বিয়ানকে ছিটকে দেওয়া ড্রিবলিং, ইকুয়েডর-উরুগুয়ের গোলকিপারকে হতবুদ্ধি করে জালে জড়ানো ফ্রি-কিক কিংবা ন্যানোসেকেন্ডের সিদ্ধান্তে পাপু গোমেজ-দি পলদের গোল এনে দেওয়া চোখধাঁধানো পাস; অন্যদিকে নেইমার মুগ্ধ করেছেন ব্রাজিলিয়ান সাম্বার স্বাদ দিয়ে যাওয়া স্টেপওভার, পাকেতা-জেসুসদের সঙ্গে মন রাঙানো ওয়ান-টু, কিংবা পায়ের নাচনে প্রতিপক্ষকে খাবি খাওয়ানো কারিকুরিতে।
কিন্তু সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে তো আর এসবই যথেষ্ট নয়, সেখানে সংখ্যা লাগে, দলে অবদানের ফিরিস্তির প্রয়োজন হয়। কোপা আমেরিকার পরিসংখ্যান বলবে, সেখানেও ফরোয়ার্ডদের জন্য প্রযোজ্য প্রায় সব তালিকায় মেসি-নেইমারই সবার ওপরে। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনার ১১ গোলের ৯টিই এসেছে মেসির ছোঁয়ায়, ব্রাজিলের ১২ গোলের ৫টি নেইমারের। দলের গোলে অবদানের হিসাবে এ দুজনের ওপরে বা মাঝে আর কেউ নেই।
৪ গোল করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি, ৫টি গোল করিয়ে টুর্নামেন্টের ‘অ্যাসিস্ট’ তালিকায়ও সবার ওপরে। ২ গোল নিয়ে নেইমার গোলদাতার তালিকার ৩ নম্বরে। মেসি আর তাঁর মাঝে আছেন নকআউট পর্বে এসে ছন্দ খুঁজে পাওয়া আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার লওতারো মার্তিনেজ (৩ গোল)। তবে গোল করানোর হিসাবে মেসি আর নেইমারের মাঝে আর কেউ নেই, ৩ গোল করিয়ে সেখানে নেইমার দ্বিতীয়।
ফুটবলের পরিসংখ্যানবিষয়ক টুইটার অ্যাকাউন্ট স্কোয়াকা জানাচ্ছে, টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করা (২০-১৭), সবচেয়ে বেশিবার ড্রিবল করে প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে যাওয়ার (৩৩-২৬) হিসাবেও মেসি নেইমারের চেয়ে এগিয়ে। তবে এ দুজনের চেয়ে এগিয়ে বা এ দুজনের মাঝে আর কেউ নেই। নেইমার মেসির চেয়ে এগিয়ে আছেন প্রতিপক্ষের কাছে ফাউলের শিকার হওয়ার তালিকায় (২৫-২২)।
সব হিসাব মেসিকেই দৌড়ে এগিয়ে রাখে। কিন্তু সেসব তো মহারণের আগের হিসাব, কাল ম্যাচে আলো ছড়িয়ে শেষ দানটা পাল্টে দিতে পারবেন নেইমার? তাঁরা দুজন অবশ্য এই ব্যক্তিগত পুরস্কার নিয়ে মোটেও ভাবছেন বলে মনে হয় না! জাতীয় দলে নিজেদের প্রথম বড় শিরোপার অপেক্ষায় তাঁরা—মনোযোগ সব সেদিকেই।
সেই শিরোপা না জিততে পারলে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার যে অর্থহীন, সে উপলব্ধি তো সাত বছর আগের জুলাইয়ের এমন এক দিনে এই মারাকানাতেই হয়েছিল মেসির!
এবার সে অসহায় উপলব্ধি হবে কার—মেসিই আবার, না নেইমার?