খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৪৫৮

প্রয়াণদিবসে মুজফফর আহমেদ‌কে স্মরণ

ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল

১৮ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছিলাম বিশিষ্ট স্বাধীনতাসংগ্রামী, দেশপ্রেমিক মুজফফর আহমেদকে যিনি তাঁর জীবন, যৌবন সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন দেশকে। ভোগবাসনার জীবনের দিকে তাঁর বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। দেশকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে আত্মগোপনে থেকে দেশের জন্যে কাজ করেছেন বছরের পর বছর, জেল খেটেছেন মাসের পর মাস, থাকা-খাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। তবু হাল ছেড়ে দেন নি।

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রা্মে বেশী বেশী মানুষকে নিয়ে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজকে এবং কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শকে নানাভাবে মানুষের কাছে পৌছে দেবার কাজটা যারা ধারাবাহিকভাবে করছিলেন তিনি তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজন হয়ে উঠেছিলেন। নানান দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে নিয়ে যে আর্ন্তজাতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল তিনি তাদের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন।

যত দিন যাচ্ছে মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাতে রাজনীতির জগতের অনেকের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যহীন বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখছেন আরও বেশি বেশি করে। এর ফলশ্রুতিতে রাজনীতি ও রাজনীতির জগতের মানুষদের সম্পর্কে তাদের মনে একটা অশ্রদ্ধা গড়ে উঠেছে। আদর্শের জন্যে রাজনীতি, মতাদর্শ নিয়ে রাজনীতি কথাগুলো যেন বইয়ের পাতার বিষয় হয়ে উঠছে। আদর্শহীনতা, মতাদর্শহীনতা, বিশ্বাসহীনতা, অস্ততার, এবেলা ওবেলা দল পাল্টানো রাজনীতির পরিবেশ যেন মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে।

একটা বড় অংশের রাজনীতিকদের দেখে মানুষের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে যে, রাজনীতিক মানেই যেন ক্ষমতার, ভোগবিলাসের অলিন্দে ঘোরার ছাড়পত্রের সন্ধান পেয়ে যাওয়া কেউ। এইরকম একটা সময়ে দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা ও প্রসারের স্বার্থেই মুজফফর আহমেদের মত মানুষদের জীবন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে নিরন্তর চর্চা করা প্রয়োজন যাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আবার স্বাধীন দেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে যারা সরকারের সাথে ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে লড়াই চালিয়ে যেতে পিছুপা হন নি।

তিনি সাদাসিধে, ধীর-স্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বিনয়-নম্রতা, স্নেহ-মমতা তাঁর স্বভাবজাত ছিল এবং সর্বোপরি তিনি নিরহংকারী ছিলেন। তাঁর জীবন যাপন ছিল সরল অনাড়ম্বর। তাঁর উচ্চ আদর্শবোধ, দেশপ্রেম অবশ্যই তুলনারহিত ছিল।

২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবাধ আর একচেটিয়া লুন্ঠনের পর স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার কাজটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না, সাথে দেশভাগের যন্ত্রণা তো ছিলই। তাই দেশ স্বাধীন হবার গণতন্র প্রতিষ্ঠা, সংবিধান প্রণয়ন প্রাথমিক কাজ ছিল ঠিকই। পাশাপাশি দেশে কৃষির অগ্রগতি, ভারী ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের কাজকেও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হচ্ছিল সরকারকে। নিজেদের দেশের মানুষদের দ্বারা পরিচালিত সরকারের প্রতি মানুষের আবেগও প্রবলমাত্রায় কাজ করছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। সেই কঠিন কাজেও তিনি জীবনপণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধু স্বাধীনতায় পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, শোষিত মানুষের সমস্যার সমাধান হবে না। তাই স্বাধীন দেশেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, শোষিত সাধারণ মানুষের পক্ষে থেকে লড়াইয়ের কঠিন পথকেই।

তিনি বলতেন কোন কমিউনিস্ট যদি ভাবেন যে, নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেই তিনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, তবে তিনি কমিউনিস্টদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেন। নির্বাচনে আমরা যদি কোন রাজ্যে সংখ্যাধিক্য লাভ করি, তবে আমরা সেই রাজ্যে সরকারও গঠন করবো এবং সেই সরকারকে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করব। তাঁর মতে, নির্বাচনের ভিতর দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভাবধারা প্রচারিত হবে আর পার্টির প্রভাব প্রসারিত হবে।

রাজনীতির জগতটা যত সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা হয়ে উঠছে, সাধারণ মানুষের থেকে রাজনীতির জগতে ধনীদের প্রভাব বেড়ে উঠছে ততই মুজফফর আহমেদের মত আদর্শবান, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক মানুষদের জীবনদর্শন, জীবনচর্চার আলোচনা গুরুত্ব হারাচ্ছে না, বরং তা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ব্রিটিশের হাত থেকে দেশকে, দেশবাসীকে মুক্ত করেও এদের কাজ থেমে থাকে নি। উন্নততর দেশ গড়ার স্বপ্নে নিজেদের জীবনকে স্বাধীন দেশের গঠনের কাজে এরা বিলিয়ে দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের মঞ্চে যুক্ত থেকে বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি একই সাথে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজকেও এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান তাঁকে কালোত্তীর্ণ প্রবাদপতিম দেশপ্রেমিক কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াইয়ের কাজে কমিউনিস্টদের অবদান প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ‘সমকালের কথা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন । তিনি লিখেছেন, “অশেষ দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে কমিউনিস্টদের কাজ করতে হয়েছে। তাঁদের না ছিল থাকার জায়গা, না ছিল খাওয়াপরার ব্যবস্থা”(১)।

১) মুজফ্‌ফর আহমেদ, সমকালের কথা, এন বি এ, ১৯৬৩, পৃ- ৬২

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত ।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!