নাতনির পরকীয়ার ঘটনা জেনে প্রেমের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় নানা শামসুল শেখ। সেই পথের কাঁটা সরাতে প্রেমিকের বুদ্ধিতে নানার শরীরে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে নাতনি কামনা খাতুন ও তার পরকীয়া প্রেমিক রাশেদ।
পরে সে হত্যার দায় চাপানো হয় সাবেক স্বামী হাসানের ওপর। স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেওয়ায় ক্ষোভে রাতের আধারে নানা শ্বশুর শামসুল শেখকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে। মামলার প্রেক্ষিতে স্বামী হাসানকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে তথ্যের ভিন্নতা পায় পুলিশ। নাত জামাই নয়, পরকীয়ার কারণেই নাতি ও তার প্রেমিক মিলে হত্যা করে শামসুক হককে। এ হত্যার ঘটনা উন্মোচন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ডিভোর্সের পরদিন (২৯ নভেম্বর) রাতে প্রেমিক রাশেদ আলী তার প্রেমিকা কামনা খাতুনের বাড়িতে আসে। তারপর ঘুমন্ত নানা শামসুল শেখের দুই পা চেপে ধরে প্রেমিক রাশেদ, আর নাতি কামনা খাতুন মুখ চেপে ধরে ইনজেকশনে কিটনাশক ভরে পুস করে করে ঘাড়ে। পরে অসুস্থ অবস্থায় শামসুল শেখকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পরদিন সকালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
ওই সময় নিহত শামসুল শেখের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন বলেন, নাতনি কামনা খাতুনকে আমরা লালন-পালন করে বড় করেছি। সে আমাদের কাছেই থাকতো। বছর দুয়েক আগে জেলার দামুড়হুদা উপজেলার জুড়ানপুর ইউনিয়নের দলিয়ারপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে জাহিদ হাসানের সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমার নাতনি কামনা খাতুনকে বিয়ে দিই। বিয়ের পর থেকেই আমার নাতনিকে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করত জাহিদ হাসান। তার সুখের কথা চিন্তা করে যৌতুক বাবদ নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তারপরও থামেনি নির্যাতন। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পারায় ৬ মাস আগে আমার নাতনি বাধ্য হয়ে জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেয়। মারধর ও নির্যাতন না করার প্রতিশ্রুতি দিলে আবারও তিন মাস পর তাদের বিয়ে হয়। এর কয়েকদিন পর আবারও নির্যাতন করতে থাকে জাহিদ। গত শনিবার ( ২৭ নভেম্বর) দ্বিতীয়বার কামনা খাতুন তাকে ডিভোর্স দেয়।
নাতনি কামনা খাতুন তখন বলেন, ডিভোর্সের পর থেকেই আমি নানা-নানির কাছে আছি। এরপর থেকে জাহিদ আমাকে ও আমার নানাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। সোমবার (২৯ নভেম্বর) রাত ১২টার দিকে আমার নানা ঘাড়ের ব্যথায় কাতরাতে থাকে। পরে আমি ও আমার নানি গিয়ে দেখি নানার বিছানার পাশে একটি খালি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ পড়ে আছে। এ সময় জাহিদ হাসান ও অজ্ঞাত দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখি। আমাদের বাড়িতে কোন প্রাচীর না থাকায় নানার ঘরে যে কেউ সহজে ঢুকতে পারে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমার নানার ওপর প্রতিশোধ নিল জাহিদ হাসান। ঘটনার কিছুক্ষণ পর নানা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা দ্রুত তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি।
ঘটনার দিন বুধবার সকালে কামনা খাতুনের মামা রফিকুল বাদী হয়ে কামনার ডিভোর্সকৃত স্বামী জাহিদ ও অজ্ঞাত দুই-তিন জনকে আসামি করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন বিকেলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান বলেন, মামলার দিন আসামি জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করি। তারপর জাহিদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে কিছুটা সন্দেহ হয়। এরপর আমি বিভিন্নভাবে খোঁজ খবর নিয়ে দেখি হত্যাকাণ্ডের রাতে জাহিদ উপস্থিত ছিলনা। ঘটনার মোড় অন্য দিকে যাচ্ছে। সেই ভেবে নাতি কামনা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকি। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মাথায় প্রেমিক রাশেদ আলীকে নিয়ে হত্যার ঘটনা স্বীকার করেন। পরে অভিযান চালিয়ে প্রেমিক রাশেদ আলীকে গ্রেফতার করি। রাশেদও হত্যার ঘটনা স্বীকার করে পুলিশের কাছে।
জবানবন্দীর বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, স্বামী হাসানের সঙ্গে ডিভোর্সের আগেই কামনা রাশেদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। সেই ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে যান নানা, বকাঝকাও করেন। পরে রাশেদের বুদ্ধিতেই ঘুমন্ত নানার ঘাড়ে কীটনাশক ভর্তি ইনজেকশন পুস করেন কামনা। নানা উঠেই রাশেদকে দেখেন। কিন্তু হাসানের চেহারার সঙ্গে মিল থাকায় অন্ধকারে তাকে হাসানই মনে করেন। তাই হাসানের নামই বলতে থাকেন।
চুয়াডাঙ্গা কোর্ট পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক আমিনুর রহমান বলেন, সোমবার চুয়াডাঙ্গা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট সাইদুল ইসলামের আদালতে কামনা খাতুন হত্যার ঘটনায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে বিজ্ঞ আদালতের বিচারক কামনা খাতুনকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তিনি আরও বলেন, এ মামলায় তিনদিন আগে আসামী জাহিদ হাসানকে এবং প্রেমিক রাশেদ আলীকে রোববার বিজ্ঞ আদালতের বিচারক জেল হাজতে পাঠানো নির্দেশ দেন। এছাড়া রাশেদ আলীকে ৭ দিন ও জাহিদ হাসানকে তিনদিনের জন্য রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান বলেন, প্রেমিক রাশেদকে নিয়ে নাতি কামনা খাতুন বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারা মোতাবেক তার নানা শামসুল শেখকে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় প্রথমে জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করি। জাহিদ হাসান তার স্ত্রী কামনাকে নির্যাতন, হত্যার হুমকির কথা স্বীকার করলেও হত্যার কথা অস্বীকার করেন। পরে ঘটনার পরম্পরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কামনাকে। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে নাটকীয় মোড় পায় মামলা। কামনা স্বীকার করেন হত্যার কথা।
খুলনা গেজেট/ টি আই