খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

‘প্রহরীর মতো জেগে’ শঙ্খ ঘোষ

ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল

আজ শঙ্খ ঘোষের জন্মদিনে লেখার শিরোনাম দিলাম ওনার কবিতার শব্দ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় জন্ম ১৯৩২ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি, বিদায় নিয়েছিলেন ২১ এপ্রিল, ২০২১ পশ্চিমবঙ্গে। বিদায় নিয়েছিলেন, আসলে আদৌ ‘বিদায়’ নেন নি তিনি এই পৃথিবী থেকে । ‘প্রহরীর মতো জেগে’ রয়ে গেছেন মানুষের চলার পথে অজস্র বাঁধার মুখে উত্তরণের নানান ফলপ্রসু পরামর্শ নিয়ে। তাই ওনার বিদায় কখনোই বিদায় হয়ে উঠবে না, চারদিকের নির্লিপ্তি আর আত্মসর্বস্বতার মধ্যে তিনি থেকে যাবেন অজস্র শব্দের মধ্যে পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মূল্যায়নের সাথে একমত না হয়ে উপায় নেই । তিনি শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে বলেছেন, “তাঁর যে মনীষার ঘরানা, সেটা বহুল শিকড়িত। তাঁর অধ্যাপনায় যে পরিশীলিত পারমিতা – এ সবই ছিল একেবারে আলাদা ….। বেপথুমান ঝাউবন, সেও একটা আলোকরশ্মি খোঁজে, একটা আলো খোঁজে, যার সম্পাতে ঝোড়ো হাওয়ার যে মঞ্জিরা- শুধু শোনা যায়, দেখাও যায় – সেরকমই একজন কবি ছিলেন এই শঙ্খ ঘোষ এবং এখনো আছেন”(১)। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কবিতার অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেই চিরকালীন আসনে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। বুদ্ধদেব বন্ধ্যোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষের কবিতাসম্ভার সম্পর্কে যে মূল্যায়ণ করেছেন তার সাথে অনেকেই হয়ত সহমত পোষণ করবেন। তার মতে, “সময়ানুগ হয়েও কবিতা রয়ে যাবে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে, অতীত পা ছড়িয়ে বসবে বর্তমানে কিংবা বর্তমান উঠে বসবে ভবিষ্যতের কোলে”।

প্রবন্ধে তাঁর বলবার ভঙ্গীতে আকর্ষনীয় যেটা সেটা হল তিনি সবসময় যুক্তিসাম্য বজায় রাখতে জানতেন । ব্যক্তিসমালোচনার ঝোঁক তাঁর মধ্যে ছিল না । নিবিড় পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে নিরপেক্ষ যুক্তি ও তথ্যকে ব্যবহার করে লিখে গেছেন । ন্ম্র অথচ দৃঢ ভাবে বলার ধরনটি রপ্ত করেছিলেন অসম্ভব মুন্সিয়ানায় । সমস্ত মতকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের বক্তব্যকে দাঁড় করাতেন এক নিরপেক্ষ সাম্যের জায়গায়। যেমন, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ‘দেখার দৃষ্টিতে’ তিনি লিখছেন – ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।

তাঁর অজস্র কালজয়ী কবিতায় বারবার দেশের নানা সঙ্কটের মূহুর্তে তিনি প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন। সব দেশের সব পরিবর্তনের লড়াইয়ে, সঙ্কটে কবি, লেখকদের ওপরেও প্রবল অত্যাচার নামিয়ে আনে শাসক – এটাই ইতিহাস বলে। তাই শুধু অ্যাকটিভিষ্টরা সব দেশে সব কালেই দেশের মূল পরিবর্তন আনতে পারেন না, পাশে লাগে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবিদের । যে সমাজে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবিরা অবহেলিত বা উপেক্ষিত বা আতঙ্কগ্রস্থ বোধ করেন, সেই সমাজ সব সময় পিছনের দিকেই এগিয়ে চলে । এটা যারা বোঝেন না, শুধু সংখ্যা বাড়ানোতে মন দেন, তাদের দুর্গ আকারে বড় হলেও হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়তে সময় লাগে না । ‘আমরা দেখি কিন্তু দেখতে পাই না’ গোত্রের তিনি ছিলেন না। তাই অন্যায় হচ্ছে মনে করলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পিছিয়ে যান নি কখনো । এটাই তার বিশিষ্টতা । এগিয়ে এসেছেন তাঁর সৃজনী শক্তি নিয়ে। বাড়িয়ে দিয়েছেন শাসকের উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষ, নির্মম ও বস্তুনিষ্ঠ শব্দমালা । ‘অরাজনৈতিক’ থেকে ‘রাজনৈতিক’ বৃত্তে এসেও কখনো কখনো শব্দ নিক্ষেপ করেছেন যা ক্রমে ক্রমে বুঁদবুঁদ থেকে ঢেউয়ে পরিণত হয়েছে । সভ্যতা, গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে বোধ করলেই তাঁর কলম এক অন্য চেহারা গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে নি। কোন পুরষ্কার বা পদের মোহে আটকে থাকেন নি । ‘নিরপেক্ষ কবি’ বর্মের আড়ালেও নিজেকে আড়াল রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি । কেউ কেউ আসেন পৃথিবীতে, নির্লিপ্ত ভাবে ‘সাতে পাঁচে থাকি না’ দিনযাপন করেন । কেউ কেউ নির্লজ্জের মত নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন । আর কেউ কেউ পথ চলার প্রতিটি বাঁকে কাজের ও অবসরের প্রতিটি মূহুর্ত সমাজকে আর দেশকে দিতে আসেন। এই শেষোক্ত ধরনের মানুষ ছিলেন শঙ্খ ঘোষ । সমাজে অবদান রেখেছেন একেবারে নিজের ছন্দে, নিজস্ব প্রকরণে, নিজের শর্তে। কোন রাজনৈতিক শৃঙ্খলাতে আবদ্ধ না করেও, কোনো ভানের আড়ালে নিজেকে না রেখেও, এমনকি রাজরোষের সম্ভাবনা সত্ত্বেও রাজশক্তিকে তোয়াক্কা না করেই তিনি মানুষকে লড়াই করতে পথ দেখিয়েছেন বারবার । লিখেছেন – ‘বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ, / মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত…’। লড়তে লড়তে বাঁধা আসবেই – এটাতো চিরন্তন সত্য। তিনি চলার পথ নির্দেশ দেন এভাবে – ‘রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন / মশাই দেখছি ভীষণ শৌখিন’। শাসকদের চিরন্তন রূপ নিঁখুত ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় – “আমি তো আমার শপথ রেখেছি / অক্ষরে অক্ষরে / যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে। /দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল/ অন্যে কবে না কথা…”। পরিবর্তনের লড়াইটা যে দীর্ঘমেয়াদী সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, অনেক সময় ধরে জমিয়ে তোলা ব্যধি আর সংকট মাত্র কয়েকদিনের জাদুস্পর্শে দূর হবার নয় । বহুদিন ধরে কাজ করে যাবার ধৈর্য প্রয়োজন। “তোষামোদে ব্যস্ত রাজকবি হতে চান নি। সেই অপরাধে নোংরা আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে বারবার। তাও থামানো যায় নি তার কলম । রাজরোষকে নির্লিপ্ততায় উপেক্ষা করেছেন । তাঁর কবিতা কখনো শ্লোগানের পর্যায়ে নেমে আসে নি যেমন, তেমনি এতটা উচ্চমার্গের হয়ে ওঠেনি যে সাধারণের বোধগম্যতা হারিয়েছে। এখানেই তাঁর অনন্যতা”(২)।

তথ্যসূত্রঃ (১)অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, যে স্তব্ধতা সত্যকাম এবং বিপ্লবী, নতুন কবিসম্মেলন, চতুর্দশ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, পৃ-৭।

(২) ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল, ‘প্রতিবাদে অনন্য কবি শঙ্খ’, নতুন চিঠি, বর্ধমান, ১৩ মে, ২০২১, পৃ-৩-৪।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!