১৯৯১ সালে আমার চাকরি জীবনের প্রথম পদোন্নতির সময় হয়ে গেল। কিন্তু আমার পদোন্নতি হলো না। একটা উটকো ঝামেলা আমার পদোন্নতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহর ইশারায় সিনিয়র এসি ডিবি জনাব মোঃ খালেক উজ জামান আবার আমার পাশে দাঁড়ালেন। তিনি আমার পদোন্নতি নিয়ে আমার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং উত্তরণের পথ খুঁজতে লাগলেন।
তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ছিলেন জনাব এনামুল হক। তাঁর সাথে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবের গভীর সম্পর্ক ছিল। ইতিপূর্বে তিনি আমার পদোন্নতির বিষয়টি পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের সাথে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু সেই উটকো ঝামেলার জন্য সম্ভব হয়নি।
হঠাৎ করে একদিন খবর এলো পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের বদলি হয়েছেন। আকস্মিক বদলির কারণ জানতে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব ছুটে গেলেন পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে। পুলিশ কমিশনার মহোদয় ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মানুষ। তিনি অধিকাংশ মানুষের নাম ও সকল ঘটনা দারুণভাবে মনে রাখতে পারতেন।
তাঁর আপন ভাই তৎকালীন কেবিনেট মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি বদলির আদেশ বাতিলের জন্য চেষ্টা না করে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নব নিযুক্ত পুলিশ কমিশনার জনাব মোহাম্মদ শাহজাহান সাহেবের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। একটু পরেই তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
হঠাৎ করে কমিশনার মহোদয় জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবকে বললেন, ‘আপনি একজনের পদোন্নতির কথা বলেছিলেন তার কি অবস্থা’?
সুযোগ বুঝে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব আর একবার আমার জন্য অনুরোধ করলে, কমিশনার বললেন,
‘এখনই একটা দরখাস্ত দেন। আমি যাবার আগে কাজটা করে দিতে চাই’।
জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের রুম থেকে বের হয়ে আমাকে ফোন করে দ্রুত কমিশনার অফিসে যেতে বললেন। ডিবি অফিস থেকে পুলিশ কমিশনার অফিসে যেতে আমার মিনিট পাঁচেক সময় লাগলো। জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব তখন কমিশনার মহোদয়ের পিএ জনাব বোরহান সাহেবের রুমে আমার জন্য অধির অপেক্ষায় ছিলেন। আমি তাঁর কাছে পৌঁছা মাত্র তিনি বললেন, ‘তোমার সমস্যার কথা উল্লেখ করে দ্রুত একটা দরখাস্ত লিখো’।
আমি কিভাবে কী করবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় পিএ জনাব বোরহান ভাই নিজেই আমার পক্ষে একটা দরখাস্ত লিখে আমার স্বাক্ষর নিলেন। অফিসিয়াল নিয়ম মোতাবেক পু্লিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে কোন দরখাস্ত দিতে হলে ডিসি ডিবি মহোদয়ের ফরওয়ার্ডিং লাগে। তাই আবার নতুন সমস্যা দেখা দিলো। একটু পরেই পুলিশ কমিশনার মহোদয় দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে ডিসি ডিবি মহোদয়ের অফিস থেকে ফরওয়ার্ডিং আনা সম্ভব নয়। তখন পিএ জনাব বোরহান ভাই আমার দরখাস্তের নিচে ‘অগ্রীম কপি’ লিখে পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করলেন। সাথে সাথে পুলিশ কমিশনার মহোদয় আমার আবেদন মঞ্জুর করলেন। আমার পদোন্নতির বাঁধা অপসারণ হলো।
ঐদিনই নবাগত পুলিশ কমিশনার হিসেবে জনাব মোহাম্মদ শাহজাহান সাহেব যোগদান করলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ। ভীষণ বদমেজাজি ও শতভাগ সৎ অফিসার। পারতপক্ষে তাঁর সামনে কোন অফিসার যেতে চাইতেন না। ডিবি পিআর অফিসে কাজ করার সুবাদে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবকে প্রতিদিন অন্তত একবার পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে যেতেই হতো। কিন্তু তিনিও মাঝে মাঝে ভয় পেতেন। তাই সুযোগ বুঝে ফাইল নিয়ে আমাকে পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে পাঠাতেন। আমি কখনো পিএ জনাব বোরহান ভাই পর্যন্ত গিয়ে কাজ সেরে আসতাম, আবার কখনো সরাসরি পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে যেতাম।
পূর্ববর্তী পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের বিশেষ বদান্যতায় আমার পদোন্নতির বাঁধা অপসারণ হলেও তখনকার দিনে এস আই থেকে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতির জন্য একটি আরএএল মিটিং এর প্রয়োজন হতো। সেখানে রেঞ্জ ডিআইজিগণ স্ব স্ব রেঞ্জের সকল এসপি সাহেবকে নিয়ে আরএএল মিটিং করে উপযুক্ত সাব ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতি দিতেন। আরএএল মিটিং এ জেলার এসপি গণ তাদের জেলার পদোন্নতির উপযুক্ত এসআইদের সারা জীবনের চাকরির আমলনামা নিয়ে মিটিংএ হাজির থাকতেন। চাকরির আমলনামা মনোপুত হলে এসপি মহোদয়ের সুপারিশক্রমে এসআইদের পদোন্নতি হতো। মেট্রোপলিটন পুলিশের এসআইদের পদোন্নতি দিতেন স্ব স্ব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার। সেখানেও স্ব স্ব ডিভিশনের ডিসিগণ আরএএল মিটিংএ বসে চাকরির আমলনামা দেখে পদোন্নতি দিতেন।
কিছুদিনের মধ্যে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব আমার কথা চিন্তা করে আরএএল মিটিং এর জন্য পুলিশ কমিশনার মহোদয়কে প্রভাবিত করলেন। আমার সাথে যুক্ত হলেন আমার প্রিয় ব্যাচমেট আনোয়ার হোসেন। তিনিও আমার মতো পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবের ঐকান্তিক চেষ্টায় আরএএল মিটিং এর দিনক্ষণ ঠিক হলো। কিন্তু সমস্যা আমার পিছু ছাড়লো না।
ডিসি ডিবি হলেন জনাব মোঃ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী। তিনি ছিলেন তৎকালীন পুলিশের জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁকে নিয়ে পুলিশ বিভাগে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। তাঁর মতো সৎ ও দক্ষ অফিসার সেই আমলে বিরল ছিল। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল। ঘটনাক্রমে আমি সেই মহান মানুষটির রোষানলে পড়ে গেলাম।
ডিসি ডিবি জনাব মোঃ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী সাহেব তাঁর সারল্যতার কারণে একজন খারাপ মানুষের প্ররোচনায় পরপর দুই জন ভাল মানুষকে আটক করলেন। তাঁরা দুজনেই ছিলেন আমার বন্ধু এবং ঢাকা শহরের বনেদী বংশের মানুষ। তাদেরকে আটক করার পর তারা দুজনেই বলেছিলেন, ‘স্যার আমরা কেমন মানুষ তা আপনার এস আই কামরুল সাহেবের কাছে জেনে দেখতে পারেন’।
এই দুটি ঘটনায় ডিসি ডিবি মহোদয় আমাকে একদিন ডেকে তাঁর রুমে নিয়ে বললেন, ‘তুমি সামান্য একজন সাব ইন্সপেক্টর। ঢাকা শহরে এত মানুষ তোমার রেফারেন্স দেয় কেন? ওরা তো খারাপ মানুষ’।
আমি আগেই জানতাম, ঐ দুইজন ভাল মানুষকে যিনি মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে ধরিয়েছেন তিনিই বেশি খারাপ। তবুও ডিসি সাহেবের সাথে তর্কে না গিয়ে সাহস করে বললাম, ‘স্যার, আপনি যাদের আটক করেছেন তারা খারাপ হলেও হতে পারে। কিন্তু তাদের খারাপ দিকটা আমি জানি না। আমি শুধু ওদের ভাল দিকটা জানি। হয়তো আমার জানায় ভুল আছে।’
আমার কথা শুনে ডিসি সাহেব তেমন কিছু বললেন না। অবশ্য তার কিছুদিন পর তাদের দুজনের আটকাদেশ মুক্ত করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার মতো কোন ত্রুটি খুঁজে পাননি। এখনও আমার সেই দুইজন বন্ধু আমাকে মন থেকে স্মরণ করেন।
যাহোক, আমার পদোন্নতির জন্য আরএএল মিটিংয়ের দিন চলে এলো। ডিসি ডিবি মহোদয় আমার চাকরির আমলনামায় ভাল মন্তব্য লিখে মিটিংয়ে সুপারিশ না করলে কোনক্রমেই আমার পদোন্নতি হবে না। জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব বার বার খবর নিতে লাগলেন। আর একটু বাদেই আরএএল মিটিং শুরু হবে। পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের পিএ জনাব বোরহান ভাই ডিসি ডিবি মহোদয়ের পিএ সাহেবের কাছে খবর নিতে লাগলেন। ইতিমধ্যে আমার আগের কর্মস্থলের আমলনামা পিএ জনাব বোরহান ভায়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সেসব আমলনামা আমার পক্ষে ছিল বলে পিএ জনাব বোরহান ভাই আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য আমলনামা হলো বর্তমান কর্মস্থলের আমলনামা এবং সেটা হবে জনাব মোঃ মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী সাহেবের হাতে লেখা।
আমার ব্যাচমেট আনোয়ার আগে থেকেই আমার কাছে এসে বসে ছিলেন। জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব মারাত্মক চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লেন। ডিসি ডিবি মহোদয়ের কাছে আমার জন্য সুপারিশ করার সাহস পেলেন না। তিনি কয়েকদিন আগের সকল ঘটনা আমার চেয়ে বেশি জানতেন। কারণ ডিসি ডিবি মহোদয় তাঁকেও আমার জন্য প্রাথমিকভাবে ধমক দিয়েছিলেন।
আরএএল মিটিংয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবের টেলিফোন বেজে উঠলো। টেলিফোনের ওপার থেকে পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের পিএ জনাব বোরহান ভাই চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘কোন চিন্তা নেই। কামরুল ভায়ের প্রমোশন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ডিসি ডিবি স্যার অসাধারণ আমলনামা লিখে পাঠিয়েছেন। একটু পরেই মিটিং শুরু হবে। সকল ডিসি সাহেব এসে গেছেন’।
পিএ জনাব বোরহান ভায়ের কথায় আমরা আশ্বস্ত হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম। মাত্র দুইজন অফিসারের জন্য বিশেষ আরএএল মিটিং শেষ হতে তেমন সময় লাগলো না। কিছু সময় পর পিএ জনাব বোরহান ভাই খবর দিলেন, আনোয়ার ও আমার পদোন্নতি অনুমোদিত হয়েছে। আমাদের অপেক্ষার অবসান হলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সবার জন্য মিষ্টি বিতরণ শুরু করলাম। আনোয়ার ও আমি জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করলাম।
একটু পর ডিসি ডিবি মহোদয় অফিসে ফিরে আমাকে তাঁর রুমে ডেকে নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন।
আনন্দ
বহুল প্রতীক্ষিত পদোন্নতি পেয়ে সেদিন আমি আনন্দে ভেসেছিলাম।
আমার অতি প্রিয় ব্যাচমেট আমার অছিলায় বিশেষ আরএএল মিটিংয়ের মাধ্যমে পদোন্নতি পাওয়ায় আমি একটু গর্বিত হয়েছিলাম।
জনাব মোঃ খালেক উজ জামান, প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার জনাব এনামুল হক, ডিসি ডিবি জনাব মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার জনাব মোহাম্মদ শাহজাহান ও পিএ জনাব বোরহান ভায়ের কাছে আমার ঋণের বোঝা বেড়ে গেল।
বেদনা
সেই পদোন্নতির জন্য আমি যাদের কাছে ঋণী হয়েছিলাম তাঁদের কোন উপকার করার মতো সামর্থ্য আমার কোনদিন হয়নি। চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)