বিশ্বের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি প্যান্ডোরা পেপার্সের চূড়ান্ত তালিকায় আরও অন্তত ৩ বাংলাদেশির নাম পাওয়া গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাতে এই তালিকা প্রকাশ করেছে।
এই বাংলাদেশিদের আর্থিক গোপনীয়তার আশ্রয়স্থল ব্যবহার করে সম্পত্তি কেনা-বেচা, সম্পদ লুকানো, কর ফাঁকি এবং বিচারিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে কোম্পানি বা ব্যাংকিং খাত এবং অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
প্যান্ডোরা পেপার্সের চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তারা হলেন— এস হেদায়েত উল্লাহ, এস রুমি সাইফুল্লাহ এবং শাহেদা বেগম শান্তি। প্রথম দুই বাংলাদেশি হংকংয়ে ট্রান্সগ্লোবাল কনসাল্টিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গোপন বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া শাহেদা বেগম শান্তির বিনিয়োগ রয়েছে জ্যাস লিমিটেড নামের একটি অফশোর কোম্পানিতে।
আইসিআইজের তথ্য অনুযায়ী, এস হেদায়েত উল্লাহ, এস রুমি সাইফুল্লাহ ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএসের নর্দা রোডের একটি বাসায় বসবাস করেন। আর শাহেদা বেগম শান্তি সিলেটের শাহজালাল এলাকার বাসিন্দা।
গত ৩ অক্টোবর প্রথম দফায় বিশ্বের প্রভাবশালী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পেশাদার সেবা দিয়ে নামমাত্র কর অথবা করবিহীন ব্যবসা ও সম্পদ কেনার কাজে সহায়তা করেছে এমন ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে তথ্য ফাঁস করা হয় প্যান্ডোরা পেপার্সে। সেই সময় আব্দুল আওয়াল মিন্টু নামের এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে প্যান্ডোরা পেপার্সে পাওয়া যায়। তিনি নেপাল থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেন বলে জানানো হয়।
যা আছে প্যান্ডোরা পেপার্সে
বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ রাষ্ট্রপ্রধান, ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের ৩ শতাধিক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রায় ১৩০ জন ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপার্সে। এটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক গোপনীয় দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনা।
এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিকদের অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে গোপনে বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য হাজির করা হয়েছে।
কীভাবে ব্যাংক এবং আইনি সংস্থাগুলো জটিল কর্পোরেট কাঠামো নকশা করার জন্য অফশোর পরিষেবাদানকারীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে প্যান্ডোরা পেপারস তদন্তে সেসবও উন্মোচিত হয়েছে। নথিপত্রে দেখা যায়, প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে ব্যবসা না করার ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও অফশোর কোম্পানিগুলো সেবাদানকারী গ্রাহকদের সবসময় চেনে না।
একই বছরের ৬ ডিসেম্বর আর্থিক কেলেঙ্কারির দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপার্সের তালিকায় ৮ বাংলাদেশির নাম উঠে আসে। সেই সময় প্যান্ডোরা পেপার্সের গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্রে বলা হয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত কোম্পানির মালিক ওই ৮ বাংলাদেশি।
দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপার্সের তালিকায় নিহাদ কবীর নামের এক বাংলাদেশি নারী ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকার ইন্দিরা রোডে তার একটি বাসা রয়েছে বলে নথিতে বলা হয়। ক্যাপিটাল ফেয়ার হোল্ডিংস লিমিটেড নামে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি রয়েছে। ২০০৮ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অফশোর কোম্পানি হিসেবে এটি নিবন্ধিত হয়।
বহুল আলোচিত এই প্যান্ডোরা পেপার্সের তালিকায় ইসলাম মঞ্জুরুল নামের আরেক বাংলাদেশিও ছিলেন। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে ওরিয়েন্টাল এগ্রিকালচারাল কেমিক্যাল কোম্পানি নামে নিবন্ধিত একটি কোম্পানির মালিক তিনি। যুক্তরাজ্যে বসবাসের পরিচয়ের পাশাপাশি ঢাকার গুলশানের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন তিনি।
এছাড়াও অনিতা রানি ভৌমিক, সাকিনা মিরালি, মোহাম্মদ ভাই, ওয়াল্টার প্রহমাদ, ড্যানিয়েল আর্নেস্তো আয়ুবাতি ও সাইদুল হুদা চৌধুরী নামে কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়; যারা বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করেছেন। তাদের মধ্যে সাইদুল হুদা, সাকিনা মিরালি এবং মোহাম্মদ ভাই গুলশানের ঠিকানা উল্লেখ করেছেন এবং অনিতা রানি ভৌমিক চকবাজারের ঠিকানা দিয়েছেন।
এই বাংলাদেশিদের মধ্যে সাইদুল হুদা বেবেন ইন্টারন্যাশনাল, অনিতা রানি এন্টারপ্রাইজ হোল্ডিংস লিমিটেড, সাকিনা মুন রেকার সার্ভিসেস করপোরেশন, মোহাম্মদ ভাই ১৯৩৬ হোল্ডিংস লিমিটেড, প্রহমাদ স্লিন্ট লিঙ্ক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড এবং ডেনিয়েল কুদেল লিমিটেড নামের কোম্পানির মালিক।
পানামার আইনি সংস্থা অ্যালেমান, কর্ডেরো, গ্যালিন্ডো অ্যান্ড লি (অ্যালকোগাল) এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের সদর দফতরে অবস্থিত ফিডেলিটি করপোরেট সার্ভিসেসের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে আইসিআইজে। বিশ্বের ১১৭টি দেশের দেড়শ গণমাধ্যমের ৬ শতাধিক সাংবাদিকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে আর্থিক এই কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপার্সে।
এই গোপনীয় নথিপত্র প্রকাশের মাধ্যমে আইসিআইজের অফশোর লিকস ডেটাবেসে এখন ৮ লাখের বেশি অফশোর কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। যা ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি তথ্য ফাঁসের ঘটনা থেকে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইসিআইজে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক এই কনসোর্টিয়ামের কাছে ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের মানুষ এবং কোম্পানির গোপন অর্থের হদিশ মিলেছে।
খুলনা গেজেট/ টি আই