‘রোজার প্রথমদিকে দুই-চারদিন কাজ হইছে। তারপরে কাজ একেবারে খুব কম। আজকে কাজে আইছি, দেখা যাক কাজে যাওয়া যায় না কি। জানি আইজকে শ্রমিকদের ছুটির দিন কিন্তু তা তো প্যাটে শোনবে না। আইছি আমাগে তো প্যাটে টান আছে, আমাগে তো কেউ খাওয়াবে না। আমাগে এই করে খাতি হয়’। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন খুলনা মহানগরীর শিববাড়ি মোড়ের ভাসমান শ্রমিক মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘যখন যেই কাজ পাই সেইটা করি। দিনে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা মজুরি হই। ৩০ দিনের ভিতর যদি ১৮-২০ দিন কাজ হয়, চলা যায়। এখন যে কাজ হচ্ছে ৫ দিন, ৭ দিন, ৮ দিন এভাবে চলা যাচ্ছে না। কাজ না হলে বাড়ি ফিরে যায়’।
বাগেরহাটের বাসিন্দা মো. আলী হোসেন বলেন, দৈনিক কাজ করে সংসার চলে। ৫০০-৬০০ টাকা মজুরি পায়। কাজ একদিন হয় তো ৫ দিন হয় না। সবসময় তো একই কাজ হয় না। কোন সপ্তাহে ৩দিন কাজ হয়, কোন সপ্তাহে ২ দিন কাজ হয়। আবার মাঝেমধ্যে পুরো সপ্তাহ হয়। কাজের যখন চাপ পরে তখন পুরো সপ্তাহ হয়।
তিনি বলেন, আজকে ছুটি কাটানোর দিন, কিন্তু বাসায় বসে থেকে কি করব। এখানে এসেছি যদি কাজ হয়, তাহলে আমারে নিয়ে যাবে ৫০০ টাকা আয় হবে।
রুপসা উপজেলার বাসিন্দা দিনমজুর মো. সেলিম বলেন, আজকে বন্ধ, বন্ধ হইলেও কিছু করার নাই, আমাগেতো কাজ কাজ কইরে খাইতে হয়। লেবারী কাজ করি। ইট, বালু, উঠাই, মিস্ত্রির সাথে যোগালী দিই। এই মোড়ে লোকজন আসে, দরকার হয় নিয়ে যায়, বিক্রি হই।
তিনি বলেন, শ্রমিক দিবস হইলেও কাজ না করলে তো চলা যায় না। কাজ কইরে আমাগে চলতে হয়। বাজার-ঘাটের যে অবস্থা, সব জিনিসের দাম বেশি। আমরা পাব কোথায় ? একদিন কাজ হয়, দুইদিন হয় না। এখাভে আমাগে দিন যাচ্ছে।
শুধু শিববাড়ি মোড়েই নয়, শ্রমিকের এই ভাসমান হাট বসে নগরীর ময়লাপোতা মোড়, সাতরাস্তা মোড়, বানরগাতি, কয়লাঘাট, বয়রা, মোস্তরমোড় ও খালিশপুরসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে। মোড়ে মোড়ে অস্থায়ীভাবে ভাসমান মানুষের শ্রম বিক্রির হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে খুলনা শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়ে তারা থাকেন। প্রতিদিন ভোরে কাজের সন্ধানে অস্থায়ী এই হাটে এসে বসেন তারা। কেউ আসলেই ছুটে একস্থানে জড়ো হন তারা। দর-দাম ঠিক হলে বিভিন্ন স্থানে কাজে চলে যান। আর না হলে সেখানেই বসে থাকতে হয় তাদের।
কয়রা উপজেলার বাসিন্দা দিনমজুর মো. মতিউর রহমান বলেন, ময়লাপোতা মোড় থেকে কাজে যায়। আমাদের ৫০০ টাকা করে দিনমজুরি দেয়। তাতে হয় না। পেট চলে না। জিনিসপত্রের দাম বেশি, বাসাভাড়াসহ সবদিক থেকে সমস্যায় আছি। দিনমজুরির দাম খুব কম। প্রতিদিন কাজ হয় না। পেটের দায়ে আজ কাজে নেমেছি।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার মো. আফজাল বলেন, ছুটির দিনে আজকে প্যাটের জ্বালায় কাজে আইছি। এক দিন কাজ হচ্ছে, দুদিন হচ্ছে না। এখানে এসে মহাজনেরা কিনে নিয়ে যায়। মাটি কাটা কাজ, রাজমিস্ত্রির যোগালী, ঘর ভাঙার কাজ এসব করি।
ডুমুরিয়ার গুটুদিয়ার বাসিন্দা সেলিম জোয়াদ্দার বলেন, আমি এখানে আসছি ভাসমান শ্রমিকের কাজ করতে, আমার সংসারের প্রয়োজন-চাহিদা মেটানোর জন্য। এই মে দিবসে আমার একটি মাত্র দাবি হঠাৎ করে আমাদের কোন একটা বোন-অথবা ভাই যদি কোন দুর্ঘটনায় কবলিত হয় তার পরিবার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে যেন নূন্যতম সাহায্য-সহযোগিতা পায়।
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ ইনসাফ খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল আমিন বলেন, আমাদের এখানে বিভিন্ন সেকশনের শ্রমিক রয়েছে। সব ধরনের কাজ আমরা করি। যে কোন লোকের যে কাজের দরকার ময়লাপোতার মোড়ে আসলে পাবে। শ্রমিকদের এক দিন কাজ হলে ১০ দিন হয় না। এই অসহায় অবস্থায় আছি আমরা। শ্রমিক দিবস পালন করবে, নাকি ভাতের চিন্তা করবে। ভাতের অভাবে এই মুহুর্তে এখানে দাড়িয়েছি। প্রত্যেক বছর ইনসাফের পক্ষ থেকে মে দিবস পালন হয়। তবে শ্রমিক যারা আছে তারা অসহায়। এদের কঠিন অবস্থা। তাদের মজুরি ৫০০ টাকা। এক কেজি চালের দাম ৭০ টাকা, বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা একদিন কাজ করলে হয় না। বাসা ভাড়া, সন্তানদের মানুষ করা এদের পক্ষে কষ্টের। খুব দূরাবস্থা।
তিনি বলেন, আমরা ভাসমান। নির্দিষ্ট কোন স্থান নেই। অসহায় হয়ে খুলনা শহরে এসে এখানে ওখানে বাসা ভাড়া নিয়ে দিনমজুরির কাজ করে। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকও আছে। রাজমিস্ত্রি, ঘরের, টিনের, মাটিকাটা, ঢালাইয়ের কাজ, বালু টানাসহ বিভিন্ন কাজ করে এসব ভাসমান শ্রমিকরা।
তিনি আরও বলেন, আজকে শ্রমিক দিবস। এই দিন দিবস পালন করে শ্রমিকেরা। কিন্তু অসহায় হয়ে সংসার বাচানোর জন্য, রুটি-রুজি দেওয়ার জন্য শ্রমিক দিবস পালন তো দূরের কথা তারা না খেয়ে এখানে আসছে। বেশি হলে একখান বিস্কুট খেয়েছে। তার বেশি কিছু খেতে পারেনি। ইচ্ছা করে আমরাও দিবস পালন করি। আমরা কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি না, প্রতিষ্ঠানের কর্ম হলে প্রত্যেকে মে দিবস পালন করতে পারতাম। যে মাস শেষে টাকা পাব। মে দিবস আমরা সুন্দরভাবে পালন করি। আমরা দিন আনি দিন খায়। জুটমিলসহ যতো মিলকরখানা বন্ধ হয়েছে, তার শ্রমিকরাও এই ফুটপাতে এসে কাজ করে।
এদিকে সকালে ময়লাপোতা মোড়ে মহান মে দিবসের র্যালি বের করে খুলনা মোজাইক মার্বেল টালী শ্রমিকরা।
খুলনা গেজেট/এনএম