খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে ৩৭ বছর পর বাড়ি ফিরলেন খুলনার জাহানারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর সংসারে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। সতীনের সংসারের কলহ থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধান শুরু করেন তিনি। তবে কপাল দোষে পড়েন মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে। চক্রের সদস্যদের বিশ্বাস করে ১৯৮৭ সালে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন খুলনা নগরীর শেখপাড়া প্রধান সড়কের বাসিন্দা জাহানারা বিবি। সঙ্গে ছিল ৭ বছরের মেয়ে মায়া। দুবাইয়ের কথা বলে চক্রটি তাদের প্রথমে ভারত, পরে নিয়ে যায় পাকিস্তান। কিছুদিন পরে চক্রের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আশ্রয় হয় করাচি থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। সেখানেই কেটে গেছে ৩৭ বছর।

এই দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে নানা চেষ্টা করেও পারেননি। গতবছর জাহানারা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাত হয় ‘দেশে ফেরা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যের সঙ্গে। সংগঠনটির প্রচেষ্টায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে জাহানারার বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাসপোর্ট ও ভিসা। সব বাঁধা পেরিয়ে দীর্ঘ ৬ মাসের প্রচেষ্টার পর শনিবার রাতে দেশে পৌঁছান জাহানারা। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর গতকাল রোববার সকালে শেখপাড়ার বাড়িতে পা রাখেন তিনি। তিন যুগ পর হারানো স্বজনকে ফিরে পেয়ে আপ্লুত জাহানারা বিবি পরিবারের সদস্যরা।

রোববার দুপুরে জাহানারা বেগমের ছোট ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বজনরা তাকে দেখতে আসছেন। হারানো স্বজন ফিরে পেয়ে আনন্দের অশ্রু সবার চোখে। ৩৭ বছর পাকিস্তানে থাকায় বাংলা মুখে আটকে যাচ্ছে জাহানারা বেগমের। সবার সঙ্গে কথা বলছেন উর্দুতেই।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার টেংরাখালী গ্রামে ছিল জাহানারা বেগমদের বাড়ি। বাবা আব্দুল ওহাব ও মা মনোয়ারা বেগমের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে জাহানারা বেগম দ্বিতীয়। পরিবারের সবাই থাকতেন খুলনার শেখপাড়া প্রধান সড়কে। আশির দশকে রূপসা নদীর ওপারের আব্দুর রশিদের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দু’বছর পর জন্ম হয় মায়া নামের কন্যা সন্তান। কিছুদিন যেতে না যেতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার স্বামী। এ নিয়ে পরিবারে ঝগড়া লেগেই থাকতো।

জাহানারা বিবি বলেন, এসব জানতে পেরে বড় বাজার এলাকার রুস্তম নামের এক আত্মীয় তাকে দুবাই যাওয়ার প্রস্তাব দেন। রুস্তমের দুই স্ত্রী, মেয়েসহ জাহানারা মোট ৪ জন রওনা হন দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে। টানা ১০ দিন বাস, ট্রেন ও নৌকা পেরিয়ে পাকিস্তানের ওই গ্রামে পৌঁছান জাহানারা। ততদিনে তারা পাচারের বিষয়টি বুঝতে পারেন। এরপর অনেক ঘটনার সব মনেও নেই তার।

জাহানারা বিবি ছোট ভাই শেখপাড়া এলাকার লৌহ ব্যবসায়ী মো. মহসীন শেখ জানান, মেঝ বোনকে বাবা সারাদেশে খুঁজেছেন। ভারতে যেতে পারে এমন আশংকায় কলকাতা, দিল্লি, আজমীর শরীফও খুঁজতে গিয়েছেন। কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। বোনকে না দেখে তিন বছর আগে বাবা মারা গেছেন। জাহানারা বিবির স্বামী ১৯৯০ সালে মারা যান।

জাহানারা বিবি জানান, তিনি দেশে ফেরার জন্য এলাকার লোকদের বলতেন। চিঠি লেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ফেরার কোনো উপায় পাননি। ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। মেয়ে মায়াকেও বিয়ে দেন সেখানে। এভাবেই দিন কাটছিল।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জাহানারা বিবি বেড়াতে যান করাচীর পাশের গ্রামে। সেখানে এক বাঙালী পরিবার দেখে জানান, তার বাড়িও বাংলাদেশের খুলনায়। বাঙালী ওই পরিবারটি তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দেশে ফেরা’ পাকিস্তানি সংগঠক অলি উল্লাহ মারুফকে জাহানারা বেগমের কথা বলেন। অলি উল্লাহ মারুফ করাচির ওই গ্রামে গিয়ে জাহানারা বেগমের ছবি ও কিছু ভিডিও বাংলাদেশের সংগঠকদের কাছে পাঠান। তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে জাহানারা বিবির ছবি ও ভিডিও আপলোড করেন। বাগেরহাটের কচুয়ার ওই গ্রামে, পরে খুলনায় যোগাযোগ করেন তারা। পরিবারের সদস্যরা ছবি দেখে বুঝতে পারেন, ওই মহিলাই তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজন।

জাহানারা বেগমের ভাইয়ের ছেলে মিশু শেখ জানান, আমার বাবা, চাচা মোহাম্মদ মোস্তফা ও মোহাম্মদ আসলাম এবং চাচাতো ভাইয়েরা সবাই ভিডিও কলে কথা বলি। আমার চাচারা নিশ্চিত করেন জাহানারা বিবিই আমাদের ফুপু। তারপর পারিবারের সবাই মিলে দেশে ফিরিয়ে আনতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করি।

তিনি বলেন, যেহেতু ৩৭ বছর আগে অবৈধভাবে পাকিস্তানে গিয়েছে। বাংলাদেশি হিসেবে তাকে দেশে আনা সম্ভব ছিল না। এজন্য পাকিস্তানে দেশে ফেরা সংগঠনের ওলি উল্লাহ মারুফের সহযোগিতায় তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট করানো হয়। কিন্তু ভিসা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। ‘দেশে ফেরা’ সংগঠনের পরামর্শে থানা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে এরপর ৯০ দিনের ভিসা দেয় সরকার। ভিসা পাওয়ার পরদিনই আমরা টিকিট কাটি। শনিবার রাতে ফুপু ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান। দীর্ঘদিন পর ফুপুকে ফিরে পেয়ে আমরা সব ভাইয়েরা খুব খুশি।

জাহানারা বেগম বলেন, অনেক কষ্টের পরে দেশে এসে ভাই-বোনদের দেখে খুব ভালো লাগছে। তিনি বলেন, মেয়ে মায়ার জন্য আবার তাকে পাকিস্তানে ফিরতে হবে। আগামী ১৬ আগস্ট তার ফিরতি ফ্লাইট।

দেশে ফেরা সংগঠনের অ্যাডমিন তানভীর হাসান জানান, ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে তাদের সংগঠকরা রয়েছেন। পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমেই হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে কাজ করেন তারা। এ পর্যন্ত ১২৭ জনকে তারা পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

 

 

খুলনা গেজেট/হিমালয়




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!