কোনো একটি সমাজ বেঁচে থাকে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মধ্যে। বাঙালি মুসলিমদের বয়স যদি হয় আটশো বছর বা তার কিছু বেশি, তাহলে বলতে হয় খণ্ডিত ভারতের বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলিমদের সাংস্কৃতিক উত্তোরণটা কোথাও যেন একটু মিটমিট। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এই কলকাতা শহর থেকে কম করে আশিটার বেশি দৈনিক থেকে শুরু করে মাসিক-পাক্ষিক-দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হোত। খোদ অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিলে কমবেশি চার-পাঁচটা দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাগরণ থেকে কাফেলা, তারপর নতুন গতি পর্যন্ত আব্দুল আজীজ আল আমানের সুযোগ্য পরিচালনায় অন্ততপক্ষে একটি লেখক- গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছিলেন। ঐ প্রসঙ্গটা পরে যাব।
এবার একটু ইতিহাসের দিকে নজর দিই। যে জাতি তার ইতিহাসটাই ভুলে সে কিন্তু নিজের মৃত্যুটা নিজেই ডেকে আনে।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে শহর কলকাতা ছিল ভারতের সংস্কৃতির পীঠস্থান। একসময় কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল। বঙ্গভঙ্গের কারণ ও পরবর্তীতে তা রদ হলেও রাজধানী চলে যায় দিল্লিতে। কিন্তু কলকাতা অবিভক্ত বাংলার রাজধানী দেশ ভাগের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ছিল। কলকাতাকে আমরা বলতে চাইলাম ব্রিটিশ বেনিয়াদের বানানো বাণিজ্যকে কেন্দ্র থেকে গড়ে উঠেছে এই মহানগরী। এই মহানগরীতে একের পর এক এসেছে পূর্ববঙ্গ থেকে জমিদার সম্প্রদায়। ইতিহাসের পাতায় লিখে দেওয়া হল কলকাতার জন্ম নাকি ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট। একসময় কলকাতার সুতানুটি-গোবিন্দপুর ব্রিটিশরা কলকাতার বিখ্যাত জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধূরীর কাছে কিনে নেয়। কিন্তু সাবর্ণ রায় চৌধূরীরা ছিলেন দিল্লির মোগল সম্রাট আজিমুস শান অধীনস্থ জমিদার। ক্ষীয়মান মোগলদের বশ করে ফেলে ব্রিটিশ সরকার। সেখানে সাবর্ণ রায় চৌধূরীরা আর কী করতে পারেন? কলকাতা শহরের সঙ্গে মোগলদের একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীর যদি নিজ ইচ্ছায় জায়গা দান না করে যেতেন, তাহলে কি আজকের কালীঘাটের মন্দির তৈরি হোত। তারকেশ্বরের মন্দিরের জায়গা দিয়ে গেছেন সেই মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। কলকাতা শহরে প্রথম ছাত্রীনিবাস তৈরি করেন বেলেঘাটা মেন রোডে বেগম সাওলাতুন্নেসা। এই মহয়সী ছিলেন অবিভক্ত চব্বিশ পরগণার দেগঙ্গা থানার ভাসিলিয়া গ্রামের জমিদার মুন্সী এজবাতুল্লার মেয়ে। কলকাতার বেলেঘাটা এলাকার বিখ্যাত জমিদার মুন্সী লতাফত হোসেন ছিলেন সাওলাতুন্নিসার স্বামী। বেলেঘাটাতে মুন্সী লতাফত হোসেন রোড তার স্মৃতি বহন করে চলে।
কলকাতা শহরে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে দৈনিক-পাক্ষিক-সাপ্তাহিক-মাসিক মিলে কম করে আশি খানা পত্র-পত্রিকা বের হোত। এর মধ্যে কয়েকটি পত্রিকা পরিচালনা করতেন অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ।
কিন্তু দেশ ভাগ মুসলিমদের বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমদের জীবনে এক অভিশাপ বয়ে আনে । তার মধ্যে আলোর ঝলকানি আমাদের কাছে অবশ্যই সাহিত্যিক-সম্পাদক-সাংবাদিক-সাহিত্য সংগঠক আব্দুল আজীজ আল আমান। তার জাগরণ-কাফেলা-নতুনগতি বাঙালি মুসলিম সমাজের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে পেরছিল। কাফেলা যুগকে বলা হয় একটি স্বর্ণযুগ। আব্দুল আজীজ আল আমান প্রতিষ্ঠিত হরফ প্রকাশনী প্রকাশনা জগতে বয়ে আনে অভিনবত্ব । একগুচ্ছ লেখক গোষ্ঠী তিনি তৈরি করেছেন। মূল স্রোতের সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আজহারউদ্দিন খান, আব্দুল জব্বার, আফসার আহমেদ, আবুল বাশার, সোহরাব হোসেন বাদ দিলেও আব্দুল আজীজ আল আমানের কাফেলা ঘরানার এম আব্দুর রহমান, সৈয়দ আব্দুল বারি, ইবনে ইমাম, রফিকুল্লাহ, মাসুদ-উর – রহমান,আব্দুর রাকিব, এ মান্নাফ, আবু আতাহার–এই লেখক গোষ্ঠী কোনো অংশে কম নয়।
আশির দশকে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে মিশন কেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। এখন পশ্চিমবঙ্গে দু-তিনটে মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকা বের হচ্ছে। অধ্যাপক ইমানুল হকের লেখনি বা তার ভাষা ও চেতনা সমিতির বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি পথ দেখায়। আই পি এস নজরুল ইসলাম রচিত প্রতিটি গ্রন্থ আমাদেরকে নতুন করে শিক্ষা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে কম করে পাঁচশোর উপর ক্ষুদ্র-ছোটবড়-মাঝারি মাপের পত্রিকা বের হয়। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানের। কিন্তু সাংস্কৃতিক মানটা এখনো সুসংহত নয়। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে কোটিপতির অভাব নেই। কিন্তু সংস্কৃতির জন্য তারা সেভাবে খরচ করে না বা করতে চায় না।
দুঃখের বিষয় আর যাদের দু- চারটে পত্র- পত্রিকা চলছে তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা প্রসার করা বাদ দিয়ে তাদের তোলাবাজি মানসিকতাটাই বেশি। তবে আশার কথা এটাই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম সমাজে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষার বিপ্লব হলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হবে, এই আশা আমরা করতেই পারি।
ইদানিং কালে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম সমাজে একটা নতুন তরুণ প্রজন্ম কাজ করছে। তাদের প্রয়াস সফল হোক। আমি আশাবাদী যে, তারা সফল হবেনই। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা শহরে বর্ণবাদী বাবু সম্প্রদায়ের উত্তরসূরিরা আজো সক্রিয়। এগুলিকে ঠেলেই বাঙালি মুসলিম সমাজকে এগোতে হবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব একটি সমাজের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঙালি মুসলিম সমাজ এগিয়ে যাবেই এই আশা করা যেতেই পারে। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি বাঙালি মুসলিম সাংস্কৃতিক প্রসার হবেই, এ ব্যাপারে আশাবাদী এবং তা হবে বাঙালি মুসলিম তরুণ প্রজন্মের দ্বারাই।
খুলনা গেজেট/এনএম