খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ আশ্বিন, ১৪৩১ | ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২১

পর্যটন শান্তির সোপান: বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪

ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম

আজ (শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেরও একটি প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে দিবসটি সারা বিশ্বে এক যোগে পালিত হচ্ছে। এ বছরেরও প্রতিপাদ্য “পর্যটন ও শান্তি” যা আমাদের দেশে সরকারি ভাবে “পর্যটন শান্তির সোপান” রূপে ভাষান্তর করা হয়েছে। জর্জিয়ার রাজধানী ঐতিহাসিক তিবিলিসি শহরে দিবসটি জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপন করছে।

১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসটি পালন করা হয়ে আসছে। এই তারিখটি ১৯৭০ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সংবিধান গ্রহণের বার্ষিকী হিসাবে চিহ্নিত, যা পাঁচ বছর পরে জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে।

বিশ্ব যখন আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ উদযাপনের জন্য একত্রিত হচ্ছে, তখন পর্যটন ও শান্তির মধ্যে গভীর সংযোগ এবং ভ্রমণ কীভাবে জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য, পুনর্মিলন এবং সুন্দর বোঝাপড়া গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে, পর্যটন শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নয় বরং এটি পারস্পরিক সম্মান, অভিজ্ঞতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য একটি বৈশ্বিক শক্তি।

পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠাঃ বিভিন্ন পটভূমি, বিশ্বাস এবং জাতীয়তা থেকে আসা মানুষকে একত্রিত করার এক অবিশ্বাস্য ও অনন্য ক্ষমতা রয়েছে পর্যটন শিল্পের। সংঘাতমুক্ত পরিবেশে পর্যটন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ সহজতর করে, পর্যটন সংলাপকে উন্নীত করে এবং পূর্ব ভুল ধারণা দূর করতে সহায়তা করে। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বপূর্ণ এলাকায়, পর্যটন পুরানো ক্ষত নিরাময় এবং পুনর্মিলনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিম্নলিখিত ভাবে পর্যটন আমাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।

সাংস্কৃতিক বিনিময়:
পর্যটকরা যখন একটি দেশ বা স্থান ভ্রমণ করেন, তারা সেই দেশের বা স্থানের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানেন ও শিখেন। আর স্থানীয়রা বৈচিত্র্যময় বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির সংস্পর্শে আসে। এই পারস্পরিক বোঝাপড়া সহানুভূতি ও সম্মান বৃদ্ধি করে, যা শান্তির জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান।

সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতা:
দায়িত্বশীল পর্যটন অনুন্নত অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় উৎপাদনের মাধ্যমে সমান অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করে, ফলে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পায়, যা প্রায়ই দ্বন্দ্বের মূল কারণ।

পরিবেশগত স্থায়িত্ব:
টেকসই পর্যটন প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে উৎসাহিত করে, দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায় গড়ে ওঠে।

পুনর্মিলন, পুনর্গঠন এবং দ্বন্দ্ব সমাধানে পর্যটনের ভূমিকাঃ
দ্বন্দ্ব পরবর্তী অঞ্চলে, পর্যটনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পুনর্মিলন এবং সমাজ পুনর্গঠনের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব দেশ যুদ্ধ বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বিভক্ত হয়েছিল, তারা প্রায়ই পুনরুদ্ধারের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে পর্যটনকে ব্যবহার করেছে।

এছাড়াও, পর্যটন সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক সমতা, টেকসই উন্নয়ন এবং অসহিংস দ্বন্দ্ব সমাধানের ক্ষমতাসম্পন্ন, গণতন্ত্রের মতো শান্তির ভিত্তি স্থাপনের সাথে সরাসরি যুক্ত।

পর্যটন নিম্নলিখিত কাজগুলোর মাধ্যমে এই ভূমিকা পালন করতে পারে:

অংশীদার-ভিত্তিক অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি:
দ্বন্দ্ব থেকে পুনরুদ্ধারকারী অঞ্চলে, পর্যটন অংশীদার-ভিত্তিক অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করতে পারে, যা পূর্বের প্রতিপক্ষদের শান্তি রক্ষায় সহায়তা প্রদান করে।

ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি:
যখন বিরোধপূর্ণ গোষ্ঠীর লোকেরা পর্যটক এবং স্বাগতিক হিসেবে মিলিত হয়, তখন এটি সংলাপের সুযোগ তৈরি করে এবং প্রথাগত পূর্বধারণা/ট্যাবু ভেঙে দেয়। এটি পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার উন্নয়ন ঘটায়।

মানবতাকে তুলে ধরা:
সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক স্থানগুলিতে ভ্রমণ ও অন্বেষণের মাধ্যমে পর্যটন মানবজাতির সাধারণ অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে যা সীমান্ত জুড়ে শান্তি এবং সংহতি বৃদ্ধি ও প্রচার করে।

শান্তিপূর্ণ পর্যটনের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যুব, উদ্ভাবন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গিঃ ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ও বিশ্ব পর্যটনের কাঠামোকে ভালো একটি আকার দিতে তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তরুণরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সৃজনশীলতা এবং শক্তি নিয়ে আসে, যা পর্যটন খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য অপরিহার্য। তরুণদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে আমরা তাদের টেকসই, শান্তিপূর্ণ পর্যটন মডেল তৈরি করার সক্ষমতা দিতে পারি।

শান্তি নির্মাণে উদ্ভাবন:
পর্যটন উদ্ভাবনী শান্তি নির্মাণ কৌশলের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রদান করে। নতুন ব্যবসায়িক মডেল এবং সৃজনশীল পর্যটন পন্থা জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের মতো সমস্যাগুলি সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে।

যুব ক্ষমতায়ন:
পর্যটনে তরুণদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করে, আমরা তাদের সম্ভাবনাকে সামাজিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে কাজে লাগাতে পারি। তরুণ উদ্যোক্তারা পরিবেশগত স্থায়িত্ব, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিকারী প্রকল্পগুলি বিকাশ করতে পারে, যা একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারে।

বৈশ্বিক শান্তি নির্মাণে পর্যটনের ভূমিকাঃ
বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ বৈশ্বিক শান্তি প্রচারে পর্যটনের ব্যপক ভূমিকা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ প্রদান করে। পর্যটন একটি সেতুর মতো যা সমাজগুলির মধ্যে সংহতি বাড়ায় যা ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করতে পারে। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সরকার, সংগঠন এবং ব্যক্তিরা শান্তি নির্মাণে প্রত্যেকের একটি ভূমিকা থাকলেও, পর্যটন একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে যাতে বৈশ্বিক স্তরে বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। শান্তির অনুসরণ একটি চলমান প্রচেষ্টা। পর্যটনের শান্তিতে অবদান রাখার সম্ভাবনা অনেক এবং এগুলিকে যথাযথভাবে অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। শান্তির জন্য পর্যটনকে একটি শান্তিসংবেদনশীল উপায়ে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি সরবরাহকারী ও ভোক্তার উভয় দিক থেকে বোঝা উচিত – শুধুমাত্র একটি পৃথক শান্তি কৌশল হিসাবে নয়, বরং শান্তির সংস্কৃতির দিকে সামাজিক রূপান্তরের অংশ হিসেবে।

“পর্যটন শান্তির সোপান” প্রতিপাদ্যটি সামাজিক সমন্বয়, অর্থনৈতিক সমতা এবং পরিবেশগত রক্ষণাবেক্ষণের চালিকা শক্তি হিসেবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। শান্তি-সংবেদনশীল পর্যটন চর্চা গ্রহণের মাধ্যমে, আমরা এমন একটি ভবিষ্যত তৈরি করতে পারি যেখানে ভ্রমণ কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবেই নয়, বৈশ্বিক শান্তি, বোঝাপড়া এবং সমাজ পুনর্মিলন ও পুনর্গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবেও কাজ করে।

বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ এর “পর্যটন শান্তির সোপান” প্রতিপাদ্যটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের সম্ভবনা অপরিসীম। পর্যটন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, একই সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি এবং সংহতি প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়।

বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ঐতিহ্য পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ এবং ভালো বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ পর্যটন উন্নয়ন দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার, টেকসই পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে পারে, যা দেশব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি।

আসুন আমরা সবাই (সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান) মিলে যার যার অবস্থান থেকে আমাদের দেশে এবং বিদেশে পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই।

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!