চলছে জুন মাস। শুরু হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ক্ষণগণনা। জুন মাস এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যবহুল একটি মাস। এই মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এই মাসেই ও ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধের মাসও জুন। আরও একটি ঐতিহাসিক তারিখ যুক্ত হতে যাচ্ছে এই মাসে, আর সেটা ২৫ জুন। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন। এজন্য দিনটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। পদ্মা সেতুর নামকরণ করে ইতোমধ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং উদ্বোধনের জন্য চলছে জোর প্রস্তুতি।
পদ্মা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সেতু। পদ্মা সেতুর অপর নাম বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া, নিজস্ব অর্থায়নে তৈরী আত্মমর্যাদার নাম। পদ্মা সেতু নিয়ে কেন এত মানুষের উচ্ছ্বাস। একটু পেছনে ফিরে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সব সময় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ উঠে দাঁড়াতে বিভিন্ন ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল। আর এই সুযোগেই বৈদেশিক দাতা গোষ্ঠী এগিয়ে এসে নানা ধরনের শর্তযুক্ত ঋণ দিতে। যাই হোক পদ্মা নির্মাণের জন্যও এগিয়ে আসে দাতা গোষ্ঠী, তবে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে মোটা অংকের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা আবার বাতিল করে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে। আর তখন থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করেন এবং সে মোতাবেক এগিয়ে যান। আজ তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে।
কৃষি সেক্টরে পদ্মা সেতু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক পরির্বতন বয়ে আনবে বলে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। শীতকাল সহ সারা বছর তাজা সবজির সবচেয়ে বড় যোগানদাতা খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর জেলা আর গদখালীর ফুল খুব সহজেই পৌঁছে যাবে ঢাকাসহ সারাদেশে। কুয়াশা ও নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে পদ্মায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকতো, ফলে পারের অপেক্ষায় থাকা ট্রাকের সবজি ও ফুল পচে নষ্ট হয়ে যেত। তাই তাঁদের কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় বাজারজাত করতে না পারার কারণে কৃষিজাত পণ্য পচে যায়। এছাড়াও কৃষকের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি নিয়ে পড়তে হতো নানা সমস্যায়। পদ্মা সেতুর ফলে সুদিন ফিরবে সবজি ও ফুল চাষীদের ।
এবার আসা যাক টাটকা মাছের বিষয়ে বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ। যদিও সেখানকার প্রতিটি জেলাতেই ধান ও মাছ চাষ হয়। নদী এলাকা বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকেও আসে এবং এসব অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে খুব সহজেই উৎপাদিত মাছ রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছবে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্যখাতেও পদ্মা সেতু সুফল বয়ে আনবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে মানুষের জন্য। উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য ঢাকা শহরে গিয়ে সেবা পাওয়া মোটেই সহজ ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। এমনকি কারো আত্মীয় স্বজন মারা গেলেও যথাসময়ে পৌঁছানো যেত না। দৌলদিয়া-পাটুরিয়া কিংবা শিমুলিয়া ঘাটের ফেরি বিলম্ব বা বিকল হওয়ার ঘটনা প্রায়ই দেখা যেত। এখন থেকে এ অঞ্চলে মানুষ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরবে ডাক্তার দেখিয়ে। ফলে সময় ও টাকা দুই’ই বাঁচবে।
এছাড়াও পদ্মা সেতুর গুরুত্ব রয়েছে নানা রকম আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং রেলপথ ০.৫৩২ কিলোমিটার। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১২ দশমিক ৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলা প্রায় ৩ কোটি মানুষ সরাসরি এর সুফল ভোগ করবেন। এজন্য রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব কমে যাবে। ঢাকা থেকে মাত্র দুই ঘন্টায় রেল ভ্রমণে পৌঁছানো যাবে যশোরে। এছাড়া পদ্মা সেতুকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়াবে মংলা বন্দর ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম। এছাড়া আশা করা যায় সুন্দরবন ও কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবস্থাও আমূল পাল্টে দেবে এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে। এছাড়াও সহজে এই অঞ্চলের কৃষিপণ্য ঢাকায় পৌঁছানো যাবে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে জিডিপি বাড়বে ১.৩৮৬ শতাংশ হারে। তবে কেউ কেউ মাওয়া ঘাটের অনেকেই গরম গরম বেছে বেছে ইলিশ ভাজা খাওয়ার হাকডাক মিস করবেন। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন ও একটি আত্মমর্যাদার গল্পের নাম।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)