১৯৭১ সাল। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। মোবাইল, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, ইউটিউব ও টিভি চ্যানেলের প্রশ্নই আসেনা। যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোন। তাও বিত্তবান পরিবার ছাড়া টেলিফোন সংযোগ ছিল না। সংবাদ জানার জন্য খবরের কাগজের উপর নির্ভরশীল হতে হতো। গল্লামারীতে বেতার কেন্দ্র সবেমাত্র চালু হয়েছে।
সারা দেশের ন্যায় খুলনা চলছে অসহযোগ আন্দোলন। খুলনা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে ব্যারিকেড। পাক বাহিনীর অবস্থান ছিল সার্কিট হাউজ, পিএমজি, নুরনগর ফায়ার সার্ভিস, রুজভেল্ট জেটি ও শিপইয়ার্ডে। প্রতিদিন হাদিস পার্ক থেকে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন। খুলনা শহরে টান টান উত্তেজনা। স্কুল কলেজ, অফিস আদালত বন্ধ। বড় বাজার, দোলখোলা বাজার, নতুন বাজার, চিত্রালী বাজার ও দৌলতপুর কাঁচা বাজার খোলা ছিল। খুলনার বিহারীরা পাক বাহিনীকে সহায়তা করছিল। বাঙালি পুলিশ, আনসার, বিডিআর অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তবে তাদের সিদ্ধান্ত একেবারে গোপনে। পাঞ্জাবী বিডিআরের কর্মকর্তারা বাঙালীদের অস্ত্র জব্দ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন বিডিআরের সদর দপ্তর ছিল রূপসা এলাকায়।
বেতারের কর্মকর্তা কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ‘বেতার কথা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ২৫ মার্চ বিকেলের অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তারা বেতার ভবন ত্যাগ করেন। রাতে গণহত্যা, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কারণে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহরের রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। রিক্সা, বাস, ট্রাক অগ্নিদগ্ধ ও দোকানের ওপর গুলিতে ঝাঁঝরা করার চিহ্ন পাওয়া যায়। শহরের প্রধান প্রধান মোড়ে সশস্ত্র সেনা পাহারা ছিল। ২৬ মার্চ সকাল থেকে বেতারের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। আঞ্চলিক পরিচালক ইব্রাহীম আকন, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আব্দুল মালেক খান ও বার্তা সম্পাদক এ আর শরীফ স্ব-পরিবারে বয়রা সার্কিট হাউজে অবস্থান করতেন। ২৫ মার্চ রাতের অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর তারা কেউ বাসভবনের বাইরে আসেননি।
২৬ মার্চ সেনা সদর দপ্তর থেকে আঞ্চলিক পরিচালকের কাছে নির্দেশনা আসে রেডিও স্টেশন চালু করার জন্য। কেউ বাইরে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। সেনা সদস্যরা বহির্বিশ্বের কাছে দেখাতে চেয়েছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। তথ্য অফিসের জনসংযোগ কর্মকর্তার সহযোগিতায় সেনাবাহিনী বেতার কর্মকর্তাদের বাসভবনের ঠিকানা নিয়ে তাদেরকে গল্লামারী বেতার ভবনে আসতে বাধ্য করে।
![](https://khulnagazette.com/wp-content/uploads/2021/03/File-Name-Oparation-Such-light-1.jpg)
এর আগে নেভীর অবাঙালি ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে রেডিও ভবনের ট্রান্সমিটার চালু করার চেষ্টা করে। বেতার ভবনে আসার আগে বেতারের কর্মকর্তারা ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পান। কিন্তু খুব গোপনেও কাউকে বলতে সাহস পায়নি। আঞ্চলিক প্রকৌশলী বজলুল হালিম চৌধুরী, বেতার কর্মকর্তা কাজী মাহমুদুর রহমান ও গোলাম কবির বেতার ভবনে এসে সম্প্রচার চালু করেন।
সামরিক নির্দেশ মত উর্দু ও বাংলা গান বাজানো শুরু হয়। সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন রকম দুঃখের গান, হামদ ও নাত বাজানো যাবে না। বেতার কর্মকর্তাদের ওপর আরও নির্দেশনা ছিল, জয় বাংলা জাতীয় কোন অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার করেল অ্যাক্ট অব সাবোটাজ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। ভারত বিরোধী প্রচার জোরদার এবং পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জনমত গঠনে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।
রেডিও ভবনে অবস্থানরত সেনা সদস্যরা বাঙালি বেতার কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করত না। বেতার ভবনের বাইরে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। প্রায় প্রতিদিন স্থানীয় সেনা সদর দপ্তরে বেতার কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হত। এ সময় কয়েকজন উর্দু ভাষী ঘোষক ও সংবাদ পাঠক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা পাকিস্তানীদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। এভাবে তিন চার দিন মার্চের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার পক্ষে, ভারত বিরোধী প্রচারণা, আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারণা, ছাত্রলীগ ও সংখ্যালঘুরা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে নানা অনুষ্ঠানাদি প্রচার করা হত। ইপিআর, বাঙালি সেনা ও পুলিশদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরে আসার নির্দেশনা প্রচার হত।
এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি ও নেজামে ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রাজনীতিকরা কথিকা পাঠ করতেন। দুই একজন সাংবাদিকও এই কথিকা পাঠের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মোট কথা রেডিওর অনুষ্ঠান এমনভাবে প্রচার হত, শ্রোতারা মনে করতেন দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।