খুলনার দাকোপে পশুর নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের মাত্রা দুই দশমিক ৪৪ মিটার। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’র সময়ে তা উঠেছিল তিন দশমিক ৩৭ মিটারে। আর বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) বিপদসীমার আরও অনেক ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। যার মাত্রা ছিল তিন দশমিক ৬৩ মিটার। বর্ষা মৌসুমে পূর্ণিমার জোয়ারে খুলনা অঞ্চলের অধিকাংশ বড় নদীতে বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার (৬ আগস্ট) থেকে কিছুটা কমলেও আগামী ৮/১০দিনে পানির উচ্চতা ফের বাড়বে বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা। ফলে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বেঁড়িবাঁধ আবারও ভেঙে বা উপচে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবার আশঙ্কা রয়েছে উপকূলবাসীর। নদীতে পানির উচ্চতা বাড়লেই উপকূলবাসীর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়; দেখা দেয় বেড়িবাঁধ ভাঙনের অজানা শঙ্কা। তবে এবার আশার আলো হয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে নতুন প্রকল্প আসছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, খুলনার নদ-নদীগুলোর পানি প্রবাহের মাত্রা নির্ণয়ে দাকোপের পশুর নদীকে নির্ণয়ক ধরা হয়ে থাকে। পশুর নদীতে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক মাত্রা দুই দশমিক ৪৪ মিটার। আম্পানের একদিন আগে ২০ মে তা বেড়ে হয়েছিল তিন দশমিক ৩৭। আর গতকাল বৃহস্পতিবার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিন দশমিক ৬৩মিটার। খুলনার সবচেয়ে বড় নদী শিবসার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ থাকে দুই দশমিক ৫৯। সেখানেও প্রবাহিত হয়েছে সাড়ে তিন মিটারের উপরে। বিভাগীয় শহর খুলনার রূপসা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল প্রায় তিন মিটার। এ নদীতে বিপদসীমার মান ধরা হয় তিন দশমিক শূন্য ৫ মিটার। একারণে পূর্ণিমার জোয়ারে রূপসা পাড়ের টুটপাড়া মেইন রোডের অনেকাংশ তলিয়ে যায়। দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, মাস্টারপাড়া, চাঁনমারী, খ্রীষ্টানপাড়া ও দারোগাপাড়ার ড্রেন উপচে ব্যস্ত সড়কে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয় জোয়ারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘পশুর নদীতে বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে; তিন দশমিক ৬৩মিটার। যার স্বাভাবিক দুই দশমিক ৪৪ মিটার। শুক্রবার থেকে পানি প্রবাহের উচ্চতা কমবে। তবে ৮-১০দিন পর আরও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আম্পানের পর বড় কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি। তবে সংস্কার করেছি বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ। আম্পানের পর দাকোপের ১২/৪৪নং পোল্ডারের প্রকল্প ঢাকায় প্রেরণ করেছি। আশা করছি, এটা অনুমোদন হয়ে যাবে। কয়রা উপজেলা বাদে অন্যান্য উপজেলার বেড়িবাঁধ অতোটা নাজুক নয়। জলোচ্ছ্বাস না হলে বাঁধের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’
পাউবো’র পানি পরিমাপক বিভাগের সূত্রমতে, পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারের চাপ বৃদ্ধি পায়। সে কারণে খুলনার গুরুত্বপূর্ণ রূপসা, পশুর, চালনা, মংলা, ভৈরব, আতাই, শাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ ও মধুমতিরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীতে পানির চাপ বেড়েছে।
সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে খুলনার কয়রা উপজেলার সর্বাধিক ২৪টি স্থানে, দাকোপে ২ দশমিক ৫কিলোমিটার, ডুমুরিয়ায় ৬টি স্থানে, দিঘলিয়ায় ২ কিলোমিটার, রূপসায় দশমিক ৭৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার সম্পুর্ণটাই স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়েছেন স্থানীয়রা।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাটি ফেলে নদী ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। তাই ব্লক ফেলে ভাঙন রোধে পাউবো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ হয়ে গেল প্রায় তিনমাস। এখনো উপজেলার বিধ্বস্ত বেঁড়িবাধ সংস্কারে কার্যতঃ পদক্ষেপ নেয়নি পাউবো। এখনো পানিবন্দী কয়রাবাসী। ঘূর্ণিঝড় প্রবন সময়টা এবছরে এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ অবস্থায় আবারও কোন আঘাত আসলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাবে কয়রা।’
পাউবো তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার বাঁধের পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর গত বছরের ডিসেম্বরে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। এরপর গত ২০ মে আঘাত হানে আম্পান। এসব দুর্যোগ খুলনার কয়রা-পাইকগাছা ও দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের মোংলাসহ অন্যান্য উপজেলা লন্ডভন্ড করে দেয়। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। উপকূলের মানুষ শুরু থেকেই বলছে, ‘ত্রাণ চাই না, পরিত্রাণ চাই/টেকসই বাঁধ চাই।’
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে আট হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। এরমধ্যে খুলনার ১৪নং পোল্ডারে ৯৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ৩১নং পোল্ডারে এক হাজার ২০১ কোটি ১২ লাখ টাকা, সাতক্ষীরার ৫নং পোল্ডারে তিন হাজার ৬৭৪ কোটি তিন লাখ এবং ১৫নং পোল্ডারে ৯৯৭ কোটি ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। শেষ হবে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে।’
খুলনা গেজেট/এআইএন