খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  রাজধানীতে ফার্মগেটে বণিজ্যিক ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট কাজ করছে
  গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে ৩ শিক্ষার্থী নিহত
  ঝিনাইদহে ২ ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাক চালকের মৃত্যু

দেশপ্রেম ও সাংবাদিকতা

নিজাম উদ্দিন আহমেদ

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে বৈশ্বিক পরিবতর্ন প্রবহমান। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, চলন, বলন, কথন সর্বত্রই এর একটা কম বেশি প্রভাব লক্ষণীয়। আগে মানুষ, সংবাদপত্রে যিনি সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাতেন তাকে সংবাদদাতা বা রিপোর্টার হিসাবে চিনতো। রিপোর্টার ইংরেজি শব্দ হলেও এটাই বহুল প্রচলিত ছিলো। কালের বিবর্তনে রিপোর্টার এখন জার্নালিস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখন রিপোর্টার বা সংবাদদাতা হিসাবে নিজেকে পরিচয় না দিয়ে জার্নালিস্ট হিসাবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৭৪-৭৮ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলাম। ওই সময়ে যে সকল প্রতিথযশা সাংবাদিক এবং সম্পাদকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম তা বিস্মৃত হওয়ার নয়। তাদের জ্ঞান, মেধা, দূরদৃষ্টি আজো আমাকে আলাড়িত করে। এদের মধ্যে সবাই এখন প্রয়াত। সর্ব জনাব গিয়াস কামাল চৌধুরী, আখতারুল আলম, নির্মল সেন, ওবাইদুল হক, সৈয়দ জাফর, এখলাস উদ্দিন আহমেদ, মাহফুজ উল্লাহ, কবি আল মাহমুদ, সানা উল্লাহ নূরী প্রমুখ। অনেকের নাম এখন স্মরণ করতে পারছি না।

সাংবাদিকতার ক্ষুদ্র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে “যিনি একটি ঘটিত বিষয়ে সত্যানুসন্ধান করে সংবাদপত্রে (সাময়িকী, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ইত্যাদি) প্রকাশ ও প্রচারের জন্য সংবাদ প্রেরণ করেন”। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখন ঘটনার সত্যানুসন্ধান কম, মতামত প্রকাশ বেশী। অর্থাৎ নিউজের চেয়ে ভিউজের প্রাধান্য দৃষ্টিকটু। মতামত প্রকাশের জন্য উপ- সম্পাদকীয় বা অন্যান্য পাতা রয়েছে। আর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- দেশপ্রেম দেশত্ববোধের অভাব। এখন শান-শওকত বিত্ত বৈভবের প্রতি আকৃষ্ট অধিকাংশ সংবাদকর্মী ।

দেশের চেয়ে নিজের ভোগ বিলাসটাই তাদের কাছে এখন অগ্রগণ্য। যা বিগত পনের ষোল বছরে ঘটেছে। যার বিবরণ এখন একে একে প্রকাশ পাচ্ছে। এতে কতিপয় স্বনামধণ্য ব্যক্তিরও নাম উঠে আসছে।
যাক যে কথা বলতে চেয়েছি, তা বলি। ভারতবর্ষে যদি কোন মসুলমান নির্যাতিত হয় কিংবা লাঞ্ছনার শিকার হয়, সেখানকার পত্রিকা খবর ঠিকই ছাপে তা আমাদের মত ন্যাংটো হয়ে না। ধরা যাক কলকাতার একটি মুসলিম পরিবার হিন্দুমৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ওদের পত্রিকা শিরোনাম করবে “রাজাবাজারে একটি পরিবারের সাথে বাক-বিতন্ডা। আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো (বিশেষ করে- প্রথম আলো, সমকাল, জনকন্ঠ ইত্যাদি) এখানে কোন হিন্দু পরিবারের সাথে অমন ঘটনা ঘটলে শিরোনাম হবে “ হাজারীবাগে একটি নিরীহ হিন্দু পরিবারের সদস্যদের উপর নির্যাতন”। এবং খরবটি প্রথম পাতা কিংবা শেষ পাতায় দৃষ্টিযোগ্য স্থানে ছাপা হবে। অন্যদিকে আনন্দবাজার ছাপাবে ভিতরের কোন এক পাতায় যাতে অধিকাংশের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

এই যে অতিমাত্রায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটানো দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য কী মঙ্গলজনক ? নাকি কারো অনুগ্রহ পাওয়ার প্রত্যাশায় ? ভারতীয় পত্রিকা (ধরুন আনন্দ বাজার) ছাপালো এমন যা অনেক পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবে ওই ঘটনা না পড়ার জন্য। সংবাদের ভিতরে দায়সারা ভাবে মুসলমান পরিবারের নাম ধাম প্রকাশ করবে। নির্যাতনকারীর প্রতি সাফাই গাইবে। কিংবা ভৎর্সনা করবে দায়ী ব্যক্তিদের।

অন্যদিকে আমাদের পত্রিকার শিরোনাম দেখলেই সকল পাঠকের চোখ আটকে যাবে ঘটনাটি আদ্যপন্ত পড়ার জন্য। সংবাদটি যথাযথভাবে বিবৃত হতে পারে বিষয়বস্তুর ভিতর, শিরোনামে নয়। এ ধরনের নোংরা চেতনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোন পক্ষকে উস্কে দিয়ে ফয়দা লুটের মতলব ছাড়তে হবে। যদি দেশের প্রতি সামান্য মমত্ববোধ, ক্ষীণ দেশপ্রেম থাকে।

পত্রিকার শিরোনাম নিয়ে ইদানিং কেমন যেন একটা অবিবেচক প্রতিযোগিতা চলছে। নবাব, সম্রাট, রাজা, বাদশা, আমির, ইত্যাদি শব্দাবলি বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোন শাসকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটাই রীতি-নীতি। যেমন সম্রাট আকবর. সম্রাট অশোক। শব্দগুলো বিশেষ্য হলেও এর মধ্যে বিশেষণের একটা প্রলেপ আছে। আজকাল অনেক পত্রিকায় শিরোনাম হয় “মাদক সম্রাট” অমকু ধরা পড়েছে। একজন সমাজ বিরোধী, রাষ্ট্র বিরোধী কুখ্যাত ব্যক্তি কিভাবে সম্রাট উপাধিতে ভূষিত হয় ? কেন শিরোনাম “কুখ্যাত মাদক পান্ডা” লিখলে অসুবিধা কোথায় ? কিংবা অন্য কিছুতো লেখা যায়। রণক্ষেত্র, যুদ্ধক্ষেত্র, কুরুক্ষেত্র ইত্যাদি শব্দ দিয়ে শিরোনাম করা হয় কোন জায়গায় অসন্তোষ, হট্টগোল, উত্তেজনাকর পরিস্থিতে ফুলিয়ে ফাপিয়ে “শ্রমিক-পুলিশ রণক্ষেত্র” শ্রমিক-ছাত্র কুরুক্ষেত্র” ইত্যাদি শিরোনাম কী শোভনীয় ? রাষ্ট্রের সম্মান ও স্থিতিশীলতার সহায়ক। অনেক খবরের সাথে অনাকাংখিত সব বিশ্লেষণ যোগ করা হয়। ভয়ংকর, ভয়াবহ, লোমহর্ষক, রক্তহিম ইত্যাদি শব্দের অযাচিত প্রয়োগ পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। উস্কানী এবং অযাচিত শব্দরাজি পরিহার দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

দেশপ্রেম নিয়ে সত্যানুসন্ধান করা এবং প্রকাশ ও প্রচার করা সাংবাদিকদের সৌন্দর্যমন্ডিত করে বলে আমার বিশ্বাস। দেশপ্রেম ও সত্যনিষ্ঠার প্রতি দায়বদ্ধতা একজন সুষমামন্ডিত সাংবাদিকদের থাকা কতটা প্রয়োজন তা একটি ঘটনার অবতারণা করে লেখাটি শেষ করছি- ঘটনাটি সম্ভবত ১৯৬৮ সালের। মরহুম আব্দুল খালেক ভাই ছিলেন দৈনক পাকিস্তান অবজারভার, খুলনার সনামধন্য সাংবাদিক। তার কাছ থেকে শোনা এই ঘটনা। তিনি একটি প্রতিবেদন তৈরী করলেন যার শিরোনাম এরকমই ছিল “খালিশপুর শিল্পাঞ্চল বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত”।
সাংবাদটি তিনদিন পরে ছাপা হলো। মরহুম খালেক ভাই তৎকালীন সম্পাদক সাহেবের নিকট (সম্ভবত শ্রদ্ধেয় আব্দুল ছালাম কিংবা শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হক) জানতে চেয়েছিলেন, স্যার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি তিনদিন পরে ছাপা হলো কেন ?

সম্পাদক সাহেব বলেছিলেন- “তোমার প্রতিবেদন সত্য, তার চেয়ে সত্য দেশের সুনাম ও উন্নয়ন, তোমার লেখাটি যদি ঐ দিন প্রকাশ করতাম তাহলে পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা পড়তে পারত। কারণ বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে ঢাকায় সরকারি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল। ঐদিন যদি তোমার প্রেরিত সংবাদটি প্রকাশিত হতো তাহলে, প্রকাশিত খবরটি বিদেশি প্রতিনিধিদের নজরে আসত, তখনকি তারা আর্থিক বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হতো ? উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এখন তোমার সংবাদটি ছাপতে আর বাধা নেই। তাই একটু
দেরী হলো। এই দেরি ইচ্ছাকৃত- কেবল দেশের সুনাম আর উন্নয়নের স্বার্থে। আমরা কী আর এমন সম্পাদক, এমন সাংবাদিকতা খুঁজে পাই।

লেখক : সহ- সভাপতি, খুলনা সাহিত্য পরিষদ




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!