একাত্তর সাল থেকে বান্দরবানের থানচি উপজেলা বাজারে ব্যবসা করে আসছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা ৬৪ বছর বয়সী সিদ্দিকুর রহমান। এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে বাজারের পাশেই একটি ঘরে বসবাস তাঁর। তবে দু’দিন ধরে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যেভাবে থানা আক্রমণ, ব্যাংক ডাকাতি, গোলাগুলি শুরু করেছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থানচি ছেড়েছেন সিদ্দিক। শুক্রবার বিকেলে বান্দরবান সদরে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন তারা।
সিদ্দিকুর রহমান জানান, ঈদ এলেও সে খুশি নেই তাঁর মনে। কেএনএফ সন্ত্রাসীদের হামলা তাঁর ঈদের ব্যবসার সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে। উল্টো জীবন বাঁচানোই এখন প্রথম কাজ। বৃহস্পতিবার রাতে কেএনএফের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির গোলাগুলির সময় ঘরে মাটিতে শুয়ে কোনো রকমে জীবন বাঁচিয়েছেন। কখন আবার কেএনএফ বাজারে হামলা করে– সে ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থানচি ছাড়ছেন।
থানচি বাজারে গত ১৩ বছর ধরে মুদি দোকান করেন চিকু মারমা। বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলির ঘটনায় গতকাল দুপুরে দোকানে তালা দিয়ে বান্দরবান সদরে পরিবার নিয়ে চলে যান তিনিও। চিকু বলেন, ‘জীবনে এমন গোলাগুলি দেখিনি। দোকানের নিচে পাহাড়ের ঢালুতে মাটিতে শুয়ে জীবন রক্ষা করেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আর থানচিতে ফিরব না।’
সিদ্দিক ও চিকুর মতোই গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থানচি বাজার এলাকা থেকে প্রায় দেড়শ পরিবার বান্দরবান সদরে চলে গেছে বলে জানা যায়। যারা এখনও আছেন, তাদেরও দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। কেউ থানচি বাজার এলাকায় থাকতে চাইছেন না। তারা বলছেন, সামনেই ঈদ ও পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা তাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। থানচি, রুমা ও আলীকদমের বাসিন্দাদের মনে উৎসবের আনন্দের চেয়ে বেশি ভর করেছে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা।
গতকাল সকালে থানচি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় ২৪০টি দোকানের মধ্যে সব মিলিয়ে ১৫টি দোকান খোলা। অন্য দোকানগুলোতে তালা ঝুলছে। যে ক’টি দোকান খোলা রয়েছে তার অধিকাংশই ক্রেতাশূন্য। বাজারে পাহাড়ি মানুষের উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। চারদিকে থমথমে, চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাজারের মোড়ে মোড়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা পাহারা দিচ্ছে।
ভাই ভাই মুদি দোকানের মালিক মো. সাইদুল বলেন, ‘আগে দিনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। গত তিন দিনে তা ৫০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। শুক্রবার মাত্র ৬০ টাকা বিক্রি করেছি। বাজারে এখন কেউ ভয়ে আসছে না।’
থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কেএনএফের অস্ত্রের মহড়া, থানায় আক্রমণ নিয়ে গোলাগুলির ঘটনায় বাজার ও আশপাশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এখন রাতেই বেশি ভয় হচ্ছে। কারণ দিনে পুলিশ ও বিজিবির অবস্থান বাড়ায় রাতের অন্ধকারে নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জীবন বাঁচাতে পাহাড়ি-বাঙালি অনেকে থানচি ছেড়ে বান্দরবান সদরে চলে যাচ্ছে।’
থানচি হেডম্যানপাড়ার বাজার-সংলগ্ন বাসিন্দা চাই হুং প্রো বলেন, ‘রাতে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে জীবন বাঁচাতে পরিবারের আট সদস্যের সবাই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতি কোনোদিন দেখিনি। দূরে আত্মীয়ের বাসায় আপাতত চলে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
থানচি উপজেলা সদরের ব্রিজের মাথায় গিয়ে এক প্রতিবেশীকে নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে এলাকা ছাড়েন টিঅ্যান্ডটিপাড়ার বাসিন্দা জুলি আক্তার। জানা গেল, তারা সন্তানদের নিয়ে বান্দরবান সদরে চলে যাচ্ছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এমন সাতটি চাঁদের গাড়ি করে ৭০-৮০ জন নারী-শিশু থানচি ত্যাগ করেন বলে জানান গাড়ির লাইনম্যান সাইফুল। থানচি উপজেলা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান অং প্র মোরং বলেন, গোলাগুলির ভয়ে অনেক পরিবার থানচি ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যাচ্ছে। আমি নিজেও গোলাগুলির ঘটনায় ভয় পেয়েছি।
থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘থানচিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত আরও ১০০ পুলিশ সদস্য থানা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের জবাব দিতে জোরদার করা হয়েছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। কিছু মানুষ থানচি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে শুনেছি।’
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও আলীকদমে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানও জোরেশোরে চলছে। ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় ৬টি মামলা হয়েছে। থানায় আক্রমণের ঘটনায় পৃথক মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।
খুলনা গেজেট/এইচ