তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই রোববার (২৮ এপ্রিল) থেকে শুরু হচ্ছে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদান কার্যক্রম। কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপে সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি দেখছেন অভিভাবকরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। কারণ, যে তীব্র গরমের কারণে গত এক সপ্তাহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, সেই গরম এখনও বিদ্যমান। ফের ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্টও জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে।
তারা বলছেন, সরকার যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেই দিচ্ছে, এখন প্রথম দিনটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুক। কোনো ধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে বলেন, তীব্র গরমের কারণে শিশুরা এমনিতেই ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে আবার হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। হিট অ্যালার্টের কারণে সাত দিন স্কুল বন্ধ ছিল, আবার হিট অ্যালার্টের মধ্যে স্কুল খুলে দিলাম! এটা কী হলো? শুধু খুলে দেওয়াই হলো না, পূর্বে শুক্রবারের পাশাপাশি শনিবারও যেখানে শিক্ষার্থীরা সাপ্তাহিক ছুটি পেত, সেটি বন্ধ করে শনিবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেন!
তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যেখানে বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিশুদের একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রত্যেক অভিভাবক এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।
ড. আবু জামিল বলেন, স্কুল চলাকালে কর্তৃপক্ষকে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন কোনোক্রমেই শ্রেণিকক্ষের বাইরে না যায়, খেলাধুলা না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পিপাসা পেলে শিশুদের পানি অথবা শরবত জাতীয় কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই গরমে খেলার মাঠে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি বা খেলাধুলা করলে যেকোনো ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।
বিশিষ্ট এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বাচ্চারা যদি বাইরের অস্বাস্থ্যকর শরবত, স্যালাইন বা আইসক্রিম খায়, এতে তাদের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। সুতরাং এই সময়টায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা খুবই জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডাক্তার এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। এই সময়ে হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশির রোগীতে ভরপুর থাকে। যেহেতু এই সময়ের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বেশি করে লেবুর পানি বা স্যালাইন খাওয়াতে হবে, ঢিলেঢালা জামা পরাতে হবে, সু-জুতা না পরালেই ভালো হয়। আর তাদের কোনো অবস্থাতেই খেলার মাঠে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
হিট অ্যালার্টের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত, তারা কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারাই ভালো জানেন। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সেটি হলো, স্কুলে এসে শিশুরা পিপাসা মেটাতে রাস্তাঘাটের লেবুর শরবত, আখের শরবত, আইসক্রিমসহ নানা ধরনের পানীয় খেতে চাইবে, মোটেও সেগুলো তাদের খেতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এগুলোতে ব্যবহার করা পানি বিশুদ্ধ কি না, আমরা কেউই জানি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পানি বিশুদ্ধ হয় না। আর এগুলো খেয়েই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু পানি আর শরবতই নয়, এই সময়টাতে বাইরের সব ধরনের খোলা খাবার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। গরমে বের হওয়ার সময় অবশ্যই বাসা থেকে ফোটানো পানি বোতলে করে নিয়ে বের হতে হবে।
অপরদিকে তীব্র দাবদাহের মধ্যে রোববার (২৮ এপ্রিল) থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক বাদে সব স্তরের ক্লাস শুরু হবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম।
সংগঠনটি বলছে, সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে সবাই বাধ্য। এ সিদ্ধান্ত মানতে গিয়ে যদি কোনো শিক্ষার্থীর শারীরিক কোনো ক্ষতি বা জীবন বিপন্ন হয়, তবে এর দায়ভার সম্পূর্ণ সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) রাতে সংগঠনের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, তীব্র তাপপ্রবাহে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ রেখে অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম তথা পাঠদানের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছিল অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। কিন্তু সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহের তেমন কোনো উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও সরকার রোববার থেকে সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার পরিপত্র জারি করেছে। ফলে ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা তীব্র তাপপ্রবাহ চলমান থাকা অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য দেশের সব মানুষ। তীব্র তাপপ্রবাহে সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের কোথাও যদি কোনো শিক্ষার্থীর কোনো রকম জীবন বিপন্ন ঘটে বা কোনো রকম ক্ষতি হয়, তার সব ধরনের দায়ভার সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, বড়রাই যেখানে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিশুদের ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা দেয়। নতুন করে হিট অ্যালার্ট জারি অব্যাহত থাকায় সামনে আরও এক সপ্তাহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমরাও আরও এক সপ্তাহ স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে অনলাইনে ক্লাস করানোর দাবি করেছি। কিন্তু সরকার তা শুনেনি। এরপর যদি কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষতি হয়, এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
খুলনা গেজেট/কেডি