গরমের তীব্রতা বাড়লেই ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীতে ভরপুর হয়ে উঠে হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে গরমের মৌসুমে এপ্রিল ও মে মাসে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। গত বছরের এ সময়টাতেও যেখানে রাজধানীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার থেকে ১২শ পর্যন্ত, সেখানে এ বছর তীব্র গরমেও হাসপাতালে আসা রোগীর হার স্বাভাবিক রয়েছে।
যদিও এ বিষয়ে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই, তারপরও কেউ কেউ বলছেন, অতিমাত্রার তাপের কারণে জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। আবার কেউ বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকায় ও রোজার মাসে দিনব্যাপী পানি না খাওয়ায় ডায়রিয়া রোগী কম।
সাধারণত, গরমের সময়ে পানির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। সবাই বেশি বেশি পানি পান ব্যবহার করেন। কারণ, গরমে পানির তৃষ্ণা বাড়ে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ যে পানি পান করছে সেই পানি দূষিত। যার ফলে গরম এলেই হঠাৎ পাতলা পায়খানার উপদ্রব শুরু হয়।
গরমের তীব্রতা বাড়লেও ডায়রিয়া আক্রান্তের হার উল্লেখযোগ্য হারে কম
আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের (২০২২ সাল) ১৬ মার্চ পূর্ববর্তী ৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দৈনিক ডায়রিয়া রোগী ভর্তির সংখ্যা ১ হাজার ছাড়ায়। সেদিন হাসপাতালে ১ হাজার ৫৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। ২১ মার্চ থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ৩০০-এর বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর দিন দিন রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। এমনকি ২৮ মার্চ ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৩৩৪ জনে দাঁড়ায়।
তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) সারা দেশে সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে আইসিডিডিআর,বির মহাখালী হাসপাতাল।
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে গরমের তীব্রতা অনেক বাড়লেও এখন পর্যন্ত ডায়রিয়া আক্রান্তে কোনো প্রভাব পড়েনি। আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, গত সপ্তাহের তুলনায় দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা বাড়লেও সেটিকে উল্লেখযোগ্য হারে ‘বেড়েছে’ বলা যাবে না। হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে দৈনিক ডায়রিয়া রোগী ছিল সাড়ে চারশর মধ্যে, এরপর ১২ এপ্রিল রোগী হয়ে গেল ৪৯১ জন, ১৩ এপ্রিল ৫১৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৫৩০ জন, ১৫ এপ্রিল ৫৬৩ জন, ১৬ এপ্রিল ৫২২ জন এবং ১৭ এপ্রিল সাড়ে পাঁচশ। সবমিলিয়ে গত এক সপ্তাহে পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশর মধ্যেই রোগী ঘুরপাক খাচ্ছে।
জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম, তীব্র গরমেও ঘাম কম
আইসিডিডিআর,বির ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস শাখার সিনিয়র ম্যানেজার একেএম তারিফুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরম সাধারণত দুই রকমের– একটি হলো যখন বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতা বেশি থাকে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময় এই চিত্রটা দেখা যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অনেকটা মরুভূমির আবহাওয়া চলছে, যেখানে গরমের তাপ প্রচুর কিন্তু বায়ুতে আর্দ্রতার পরিমাণ কম। বাতাসে যদি আর্দ্রতা বেশি থাকে, তাহলে ঘাম বেশি হয়, আর্দ্রতা কম থাকলে ঘামও কম হয়। যে কারণে শরীর দুর্বল কম হয় এবং ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শরীর ঠিক মতো লড়াই করতে পারে।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে গরম চলছে, এই গরমে সাধারণত ডায়রিয়ার প্রকোপ কম হয়ে থাকে। কারণ এখনকার গরমে বাতাসের আদ্রতা কম, এ কারণে তীব্র গরমেও মানুষ কম ঘামে। কিন্তু যে গরমে মানুষ তীব্র ঘামে, তখন শরীর থেকে অনেক লবণ-পানি চলে যায়।
তারিফুল ইসলাম বলেন, আপনারা জানেন ডায়রিয়া হলো একটি পানিবাহিত রোগ, এর বড় একটি কারণ হলো, আমরা যে পানিটা খেয়ে থাকি তা অনেকাংশেই দূষিত। এই পানিটা যখন আমরা কম খাই তখন আমাদের বডি সেটিকে এনকাউন্টার করতে পারে। আর যখনই আমরা বেশি পানি খাই, এক গ্লাসের জায়গায় দুই গ্লাস পানি খাই, তখন জীবাণুটা শরীরের জন্য প্রতিরোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। যে কারণে ওই সময়টাতে আমরা অসুস্থ হয়ে যাই।
রোজায় তীব্র তাপমাত্রায় পানি পানের হার কম
আইসিডিডিআর,বির এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা জানি ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানির কারণেই পেটের ভেতর ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে এবং ডায়রিয়া সংক্রমণ দেখা দেয়। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবছর ডায়রিয়া কম হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হতে পারে রোজার মাস। বর্তমানে রমজান মাস চলার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দিনের বেলায় মানুষের পানি কম খাওয়া হয়।
তারিফুল ইসলাম বলেন, বছরের দুই সময়ে এই আউটব্রেকটা বেড়ে যায়। বর্ষার আগে যেটাকে আমরা প্রি-মনসুন পিরিয়ড বলি আর শীতের আগে। প্রি-মনসুন সিজনে আমাদের আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা সাতশ থেকে সাড়ে সাতশতে চলে যায়। কিন্তু এখন আমাদের হাসপাতলে রোগী আছে সবমিলিয়ে পাঁচশর মতো, যেটিকে আমরা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিই। এখনো ডায়রিয়া আক্রান্ত সংখ্যা বাড়তে পারে যদি ইমিউনিটি বেড়ে যায়।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। রোগীর সংখ্যা কিছু পরিমাণ বাড়লেও সেটি পাঁচশর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, এই কারণে আমরা এটিকে ওই অর্থে বেড়েছে বলছি না। গত কয়েকদিন ধরে আইসিডিডিআর,বিতে ৫১০-৫২০ জনের মধ্যে আছে। যদিও সপ্তাহখানেক আগে রোগীর সংখ্যা সাড়ে চারশর মধ্যেই ছিল। আমরা ৫০০ পর্যন্ত স্বাভাবিকই ধরি, রোগী কিছুটা বাড়লেও বলার মতো বাড়েনি। কারণ, গত বছরের এসময়টাতেও দৈনিক এক হাজার-১২শ করে রোগী থাকত।
তিনি বলেন, গত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী ছিল সাড়ে চারশর মতো, এরপর ১২ এপ্রিল রোগী হয়ে গেল ৪৯১ জন, ১৩ এপ্রিল ৫১৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৫৩০ জন, ১৫ এপ্রিল ৫৬৩ জন, ১৬ এপ্রিল ৫২২ জন এবং ১৭ এপ্রিল সাড়ে পাঁচশ। সবমিলিয়ে গত এক সপ্তাহে পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশর মধ্যেই রোগী ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এই সংখ্যা যদি ছয়শ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ধরে নেব যে ‘আউটব্রেক’ হচ্ছে।
বাহারুল আলম বলেন, এ বছর তো গরম অনেক তীব্র, গতবার রোগীর সংখ্যা বেশি থাকলেও এরকম গরম ছিল না। এর থেকে ধারণা করা যায়, গতবারের আউটব্রেকটা দূষিত পানির কারণেই ছিল। শুধু গরমেই যদি বাড়ত, তাহলে তো এই বছর রোগী গত বছরের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ হতো।
মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা ডায়রিয়া সংক্রমণ কম হওয়ার কারণ হতে পারে
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতাল প্রধান বলেন, মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রাও ডায়রিয়া সংক্রমণ কম হওয়ার কারণ হতে পারে। যদিও এটা এখনো গবেষণায় প্রমাণিত নয়, কিন্তু আমাদের সাইনটিস্টরা বলছিল যে, সাধারণত ৩০ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়াগুলো সুবিধাজনকভাবে গ্রো (প্রসারিত হওয়া) করতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা যদি ৪০ ডিগ্রির ওপরে চলে যায়, তাহলে ব্যাকটেরিয়ার গ্রো করা খুব কঠিন। আমাদের ল্যাবগুলোতেও যখন ব্যাকটেরিয়া কালচার করা হয়, তখন ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। আর সেই তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায়, তখন তাদের জন্য পরিবেশটা কঠিন হয়ে যায়।
গরমে সাধারণ মানুষের জন্য পরামর্শ জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরমটা যেহেতু অতিমাত্রায়, এসময়ে মানুষের অনেক বেশি তৃষ্ণা পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে মনে রাখতে হবে, তীব্র গরমের পর হঠাৎ করেই ঠান্ডা পানি খাওয়া উচিত নয়। যে পানিটাই খাবেন, চেষ্টা করবেন যেন বিশুদ্ধ পানি হয়।
ডা. বাহারুল আরও বলেন, ছোটদের জন্য পরামর্শ হলো– বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে তারপর খাওয়াতে হবে। এছাড়াও বাটি, চামচসহ যা যা প্রয়োজন হয়, সেগুলো ভালো করে ধুতে হবে। বড়দের জন্য পরামর্শ হলো– শরীরের তাপমাত্রা সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিমাত্রার তাপে ঘরের বাইরে বের না হলেই ভালো। হঠাৎ করে কোনো প্রকার ঠান্ডা জিনিস খাওয়া যাবে না।
খুলনা গেজেট/ এসজেড