দেশে গত তিন দিনে রাজধানী ও পটুয়াখালীতে দুই সাংবাদকর্মী খুন হয়েছেন। এছাড়া রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে আদালত জামিন দিয়েছেন।
এদিকে রাজধানীতে সংবাদকর্মী হত্যা, রাঙ্গামাটিতে এক সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে সাংবাদিক নেতার ওপর হামলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা।
হাতিরঝিল থেকে আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার
রাজধানীর হাতিরঝিল লেকপাড় এলাকা থেকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে গুলশান থানা পুলিশ। বুধবার (৮ জুন) সকালে গুলশানের পুলিশ প্লাজার উল্টো দিকের সড়কের পাশ থেকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, আবদুল বারীকে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে আব্দুল বারী খুনের ঘটনায় তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে চলছে শোকের মাতম।
পুলিশ জানায়, সকালে ছিন্নমূল কয়েকজন শিশু নিকেতন সংলগ্ন হাতিরঝিল লেকপাড়ে একজনের মরদেহ দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে গুলশান থানা পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান ফিরোজ গণমাধ্যমে জানান, মরদেহ এবং আলামত দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আবদুল বারীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ঘাতকরা। পুলিশের ধারণা, প্রথমে বারীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, পরে তিনি প্রাণ বাঁচাতে পানিতে নেমে পড়েন। কারণ, তার জামা কাপড় ভেজা ছিলো। এক পর্যায়ে পানি থেকে লেকপাড়ে উঠে এলে তাকে মাটিতে শুইয়ে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল আরও জানান, ঘটনাস্থলে মরদেহের পাশ থেকে রক্তমাখা ছুরি, মানিব্যাগ এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
পুকুর থেকে সাংবাদিক প্রদীপের মরদেহ উদ্ধার
গত রবিবার (৫ জুন) রাত ২টার দিকে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নিজ বাড়ির পুকুর থেকে আবু জাফর প্রদীপ (৩৫) নামে এক সাংবাদিকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আবু জাফর প্রদীপ ওই এলাকার মৃত আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে। তিনি সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন এর কলাপাড়া শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক সরেজমিন পত্রিকার কলাপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তার এক ছেলে ও মেয়ে সন্তান রয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জাফর রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। রাত গভীর হলেও তিনি বাড়িতে না ফেরায় স্বজনরা তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। পরে বাড়ির পুকুরে তার মরদেহ ভেসে ওঠে। খবর শোনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে। তবে কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে সেটা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
রাঙ্গামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহী গ্রেপ্তার ও জামিন
মঙ্গলবার (৭ জুন) সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি শহরের এডিসি হিলের নিজ বাসা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বুধবার (০৮ জুন) দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে রাঙ্গামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ফাতেমা বেগম মুক্তা তার জামিন মঞ্জুর করেন।
আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের পর আজ রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার আদালতে তোলা হলে তার জামিনের আবেদন করা হয়। আসামির সামাজিক মর্যাদা ও সাংবাদিকতার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হলে, আদালত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেছেন।
রাঙ্গামাটি জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে সাত কার্য দিবসের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার শর্তে আসামিকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালে রাঙ্গামাটির সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনুর মেয়ে নাজনীন আনোয়ার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ডিসি বাংলো পার্কের একটি জায়গা রেস্টুরেন্টের জন্য লিজ নেন। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে নাজনীন আনোয়ারের ঝামেলা হয়। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে সংবাদ প্রকাশ করেন ফজলে এলাহী। এতে নাজনীন আনোয়ার ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগটি এতদিন প্রক্রিয়াধীন ছিল। এরই মধ্যে নাজনীন আনোয়ার অভিযোগটি চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন। অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিয়ে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার পরপরই কোতোয়ালি থানা পুলিশ ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তার করে।
বিভিন্ন ব্যক্তিদের উদ্বেগ
বুধবার (৮ জুন) এক যৌথ বিবৃতিতে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের ২১ জন প্রতিনিধি উদ্বেগ প্রকাশ করে এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন
বিবৃতিতে বলা হয়, রাজধানীর হাতিরঝিলে বুধবার (৮ জুন) সকালে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারীর ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার, মঙ্গলবার (৭ জুন) রাতে রাঙ্গামাটিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির প্রতিনিধি ও স্থানীয় দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পাদক ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তার এবং গত রবিবার (৫ জুন) জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ওমর ফারুকের ওপর হামলা চালানো হয়। মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন নিশ্চিত ও গণতন্ত্রের স্বার্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা অপরিহার্য। অথচ সরকার গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানিরোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের আশ্বাস দিলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশ্নবিদ্ধ এই আইনের আওতায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
দীর্ঘ প্রায় একযুগেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার ঘটনাকে গণমাধ্যমকর্মী সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের বড় দুর্বলতা বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে সাংবাদিক ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার, সংবাদকর্মী আব্দুল বারী হত্যা ও সাংবাদিক নেতা ওমর ফারুকের ওপর হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের জোর দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও জানান নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
বিবৃতিদাতারা হলেন- কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন, শিশুসংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুর রহমান সেলিম, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশের (জিসিবি) কার্যকরী সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, নৌপ্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মানিকলাল ঘোষ, প্রভারটি ইমুলিনেশন এ্যাস্ট্যিান্স সেন্টার ফর এভরিহোয়্যারের (পিস) নির্বাহী পরিচালক ইফমা হুসেইন, উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের সদস্যসচিব আমিনুর রসুল বাবুল, আলোকিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাপ্পিদেব বর্মণ, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম, মিডিয়া ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস এণ্ড এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্ট (মেড) নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম সবুজ, হকার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার হায়াৎ, সাংবাদিক ও শিশুসংগঠক রাজন ভট্টাচার্য, জনলোকের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী রফিকুল ইসলাম সুজন, ঢাকা উত্তর নাগরিক ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তফা কামাল আকন্দ, পুরানো ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন এবং মুক্তি শিখার আহ্বায়ক জিহাদ আরিফ।
খুলনা গেজেট/ আ হ আ