লাল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ, রূপালি রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্প, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল এসব মাছগুলো পুকুরের পানিতে ভাসছে, ডুব দিচ্ছে যা দেখলে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়। শৌখিন মানুষ সাধারণত তাদের বাসাবাড়ির অ্যাকুরিয়ামে শোভাবর্ধনে রাখেন এইসব বাহারি রঙের মাছ।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের নারাঙ্গালি গ্রামের তারুণ সালমান সরদার। তিনি এখন বেশ জোরেশোরেই চাষ করছেন এসব রঙিন মাছ (অরনামেন্টাল ফিস)। তার সফলতায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মাছ।
২০১৮ সালের শেষের দিকে খুলনা শহরের একটি অ্যাকুরিয়াম ফিসের দোকান থেকে শখের বশে দেড় হাজার টাকা দিয়ে ৬০ পিস রঙিন মাছ কিনে আনেন সালমান সরদার। তখন তিনি মাছের নামও জানতেন না। পরে জানতে পারেন সেগুলো হচ্ছে গোল্ড ফিস ও কমেট প্রজাতির। গ্রামের বাড়িতে ধান সেদ্ধ করার হাউজে সেগুলো রেখে দেন। এভাবে সময় পার হয় কিছু। ছয় মাস পর পানি পরিবর্তন করার সময় দেখতে পান মাছগুলোর মধ্যে কয়েকটির পেটে ডিম। এদের বিষয়ে কিছু জানা ছিল না বিধায় অসাবধানতাবশত ৫টি মাছ মারা যায়। পানি পরিবর্তনের পর দেখতে পান, সেগুলো ডিম ছেড়েছে। বুঝলেন পানি পরিবর্তন করা হলে এগুলো ডিম পাড়ে। এরপর বংশবৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের আবাস করা হয় আরও চারটি হাউজে।
সালমান সরদার বলেন, ‘এখন আমার খামারে ৫২ প্রজাতির রঙিন মাছ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- গোল্ড ফিসের কয়েকটি প্রজাতি যেমন অরেন্ডা, রেডক্যাপ, ব্ল্যাকমোর, রুইকিন, লিচি ইত্যাদি। এছাড়াও আছে কমেটের তিন প্রজাতি ক্যালিকো, সাধারণ কমেট আর তিন লেজওয়ালা কমেট (এটি খামারে ক্রস করা), গাপ্পির সাত প্রজাতি, মলি, শর্টবেল, প্লাটি, জাপানি কইকার্প, থাইল্যান্ডের মিল্কি, মিল্কি বাটারফ্লাই ইত্যাদি।
১৫০০ টাকার মাছ দিয়ে শুরু করে এখন সালমানের খামারে রয়েছে ৩০ হাজার প্যারেন্টস, ১০ লাখের বেশি রেণু আর তিন লাখের বেশি ধানি মাছ। যার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৬০ লাখ টাকার বেশি। বর্তমানে নিজ গ্রাম নারাঙ্গালিসহ আশপাশের গ্রামে তার ১৫টি পুকুর রয়েছে, খনন করা হচ্ছে আরও দুটি। আসছে নতুন বছর ২০২১ সালের শুরুতে আরও ১৩টি সহ মোট ৩০টি পুকুরের টার্গেট রয়েছে সালমানের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে ঝিকরগাছার ‘পানিসারা-গদখালি অঞ্চল যেমন ফুলের রাজধানী হিসেবে খ্যাত, তেমনি এই অঞ্চলকে আমি রঙিন মাছের রাজধানী করে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চাই।’
সালমানের রঙিন মাছের খামারে এখন ২৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। সপ্তাহে তিন-চারদিন জেলেরা এসে জাল টানেন। তারা শুরু থেকেই রয়েছেন।
আইন কলেজের ছাত্র সালমানের খামারে যারা কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই ছাত্র। তারা কেউ কেউ সরকারি এমএম কলেজ ছাত্র, কেউ সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র এবং কয়েকজন এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকায় তারা এখানে কাজ করছেন।
সালমান বলেন, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি মাছ বিপণন শুরু হয়। আশপাশের এলাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন আসেন মাছ কিনতে, চাষাবাদ পদ্ধতি শিখতে। গ্রামের অন্তত ১০জন উদ্যোক্তা তার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। দেশের অন্যান্য জেলায় এমন উদ্যোক্তা হয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি।
সালমানের বেশিরভাগ সময় কাটে মাছের খামারে। সরকারি কোনও সহযোগিতা ছাড়াই আজ তিনি এই অবস্থানে। রাত জেগে জেগে তিনি দেখেছেন মাছেদের চলাচল। লক্ষ করেছেন মাছগুলো সোজা সাঁতার কাটে না। সে কারণে রেণুপোনা উৎপাদনের ট্রে তৈরি করেছেন ঘুরিয়ে, ধাপে ধাপে। নিজস্ব চিন্তা থেকেই এগুলো করা। মাছেদের খাবার, চিকিৎসা সবকিছুই করেন নিজেই।
সালমান বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি মাছদের মূলত পাখনা পঁচা, শিকড়/উঁকুন, ক্ষত রোগ, ফুলকা পঁচা রোগ হয়। এগুলোর চিকিৎসায় পরিমাণ মতো লবণ, পটাশ, ফিটকিরি আর চুন ব্যবহার করি। এগুলো দিয়ে দেখেছি তাদের রোগ সেরে যায়।’
মূলত ধানি মাছ (সাইজ ২ ইঞ্চি) বেশি বিক্রি হয় বলে জানান এই উদ্যোক্তা। খামার থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ ব্যাগে এসব মাছ বহন করে নিয়ে যায় ক্রেতারা। তিনি গোল্ড ফিস প্রতি পিস ২০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এছাড়া কমেট ১০ টাকা, গাপ্পি মলি, শর্টবেল ইত্যাদি ১০ টাকা। মাসে খরচ বাদে লাখ টাকার উপরে তার লাভ থাকে বলে জানালেন।
স্বপ্নিল পরিবার ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা রয়েছে সালমানের। এই সংস্থার মাধ্যমে এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষের সেবা করে থাকেন। করোনাকালে তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি গোপনে খাবার, স্যানিটাইজারসহ নানা সামগ্রী দিয়েছেন। মাছের আয়ের অংশ থেকেই মূলত এসব সেবামূলক কাজ করেন বলে জানালেন এই তরুণ। ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিবন্ধী যে কেউ মাছের খামার করতে চাইলে বিনামূল্যে তাকে সকল সুবিধা দেওয়ার।
সালমানের বিষয়ে জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ার কবীর বলেন, ‘আমি শুনেছি, নারাঙ্গালি এলাকায় এক তরুণ এই রঙিন মাছ চাষ করছেন। দু’একদিনের মধ্যে সেখানে ভিজিটে যাবো। সালমান যদি চান, তাহলে আমরা তার খামার ভিজিট করে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের কিছু অর্থ পেতে তাকে সহায়তা করবো।’
তিনি বলেন, ‘বছর তিন আগেও বিদেশ থেকে এইসব অর্নামেন্টাল ফিস আমদানি করা হতো। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত এই রঙিন মাছ সেই চাহিদা পূরণ করছে। খুব শীঘ্রই আমরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশে এই মাছ রফতানি করতে পারবো। ঘরের শোভা বাড়ানো ছাড়াও এখন পুকুরে চাষকৃত এইসব মাছ বেশ বড় হয়, সেকারণে সেটি খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।’
খুলনা গেজেট/এনএম