ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্মাণ কাজ করার সময় একটি পুরনো বোমা উদ্ধারের খবর বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণ কাজ চালানোর সময় বুধবার মাটি খুড়ে বোমাটির সন্ধান পায় নির্মাণ শ্রমিকরা। পরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সেটি উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানায়, ২৫০ কেজি ওজনের বোমাটি একটি জেনারেল পারপাস (জিপি) বোমার মতো। উদ্ধার করার পর ঘটনাস্থলে সেটি নিষ্ক্রিয় করার পর বিমান বাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট বোমাটিকে ময়মনসিংহের রসুলপুর বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যায়। সেখানে বোমাটি ডিমোলিশ বা ধ্বংস করা হবে বলে আইএসপিআর থেকে জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ৩ ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো শত্রুপক্ষ পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তখনকার ওই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ – মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যিনি বীর উত্তম খেতাব পান। বিবিসি বাংলাকে ক্যাপ্টেন আহমেদ বলেন, যুদ্ধের সময় মূল বিমানবন্দরগুলোতে হামলা চালানোর কাজটি করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী, কারণ বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর তখনও মূল বিমানবন্দরে হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা ছিল না।
তিনি জানান, মূল বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত ঘাটিগুলোতে হামলা করতো বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। “মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে শত্রুদের জ্বালানি সরবরাহের যে ডিপোগুলো ছিল সেখানে হামলা চালিয়েছিল বাংলাদেশের বাহিনী। চট্টগ্রামে বিমানবন্দরের কাছেও একটি ডিপো ছিল সেটিও উড়িয়ে দেয়।”
এই হামলা চালানোর পরের দিন ভোরে ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান তিনটি বিমানবন্দর ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরে বিমান হামলা চালায়। আর এ কারণেই ঢাকার বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার হওয়া বোমাটি ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে ফেলা হয় বলে মনে করেন তিনি। “ওই হামলা চালানোর সময় এর কোন একটিতে হয়তো উদ্ধার হওয়া বোমাটি ব্যবহার করা হয়েছিল,” বলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন আহমেদ মনে করেন যে ঢাকায় উদ্ধার হওয়া বোমাটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ছিল না। “আমাদের যে হেলিকপ্টার ছিল তার গতি ছিল ৮০ মাইল। যে অটার বিমানটি ছিল সেটার গতি ছিল সর্বোচ্চ ১১০ মাইল। এগুলো নিয়ে হামলা চালানো খুবই বিপদজনক ছিল।”
ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একজন মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, যে কোন যুদ্ধের কৌশল হচ্ছে পদাতিক বাহিনী যেন এগিয়ে যেতে পারে, সেজন্য প্রথমেই টার্গেট করে শত্রুপক্ষের বিমান বাহিনী ও বাহিনীর ঘাটি ধ্বংস করা। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ঠিক এটাই করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাছাই করা যেসব হামলা চালানো হয়েছিল, তার মধ্যে তৎকালীন তেজগাঁ বিমানবন্দরে হামলা ছিল উল্লেখযোগ্য। আর যে বোমাটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি ওই হামলা থেকেই এসে থাকবে বলে মনে করেন জেনারেল রায় চৌধুরী।
ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, যুদ্ধের সময় ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে বিমান হামলা চলেছিল ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর পর আর বিমান হামলার দরকার পড়েনি, কারণ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কোন শক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না। “এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী ঢাকাকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলে,” বলেন তিনি।
জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় বাহিনী মূলত মিগ-২১ এবং ক্যানবেরা বিমান ব্যবহার করেছিল। “যে বোমাটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি সম্ভবত ক্যানবেরা বিমান থেকে ফেলা হয়েছিল,” বলছিলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন বলেন, ২০০ বা ২৫০ কেজি ওজনের বোমাগুলো মূলত কোন স্থাপনা ধ্বংসের কাজে বা কোন ঘাটি লক্ষ্য করে বড় ধরণের ধ্বংসযজ্ঞের জন্য নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, বিমান বন্দরের রানওয়েতে যদি এই বোমা ফেলা হয় তাহলে সেখানে বড় ধরণের গর্ত তৈরি হয়, ফলে রানওয়ে পুরোপুরি অকেজো হযে পড়ে। যার কারণে শত্রুপক্ষের বিমান ওঠা-নামা করতে পারে না। মূলত এটিই ছিল বিমান বন্দরে হামলার উদ্দেশ্য, বলেন তিনি।
বোমা বিস্ফোরিত হয় না কেন ?
আকাশ থেকে ফেলা একটি বোমা বিস্ফোরিত হবে কি-না, তা মূলত কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। বোমাটি বিস্ফোরিত হবে কি-না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা নির্ভর করে সেটি কোন সারফেস বা কোন জায়গায় গিয়ে পড়েছে, বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলছিলেন।
তিনি বলেন, বোমাটি যদি কংক্রিটের উপর পরে তাহলে সেটি সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়। আর যদি সেটি নরম মাটি বা কাদার মধ্যে পড়ে তাহলে সেটি বিস্ফোরিত হয় না। সেটি কাদা বা মাটিতে ঢুকে যায় এবং পরে অনেক দিন ধরে টিকে থাকতে পারে।
মি. আহমেদ বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেলা হয়েছিল এমন অনেক বোমা এখনও পাওয়া যায়, যেগুলো অবিস্ফোরিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
এ বিষয় ভারতীয় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বলেন, মূলত কাদামাটি বা জলাভূমিতে কোন বোমা পড়লে সেটি বিস্ফোরিত হয় না। এছাড়া বোমাটি ছোড়ার সময় যদি সঠিক পদ্ধতি মানা না হয় কিংবা এক্ষেত্রে কোন ধরণের ত্রুটি থেকে যায়, তাহলেও অনেক সময় বোমা বিস্ফোরিত হয় না বলে জানান তিনি। “বোমার যে মেকানিজম, যেটা দিয়ে এটি ফাটে, সেটি হয়তো কাজ করেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা হয়। বোমা ফাটানোর যে সুইচ থাকে, সেটা অনেক সময় কাজ করে না। তবে এটা ইচ্ছাকৃত নয়।” সূত্র : বিবিসি বাংলা।
খুলনা গেজেট/কেএম