খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

ডাক্তার মিলন নিহত হওয়ার সেই ভয়াবহ দিন

এ এম কামরুল ইসলাম

পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সকল অফিসার হঠাৎ মহাব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওয়ারলেসের কথাবার্তা শুনে বুঝা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোলাগুলিতে কোন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। কারফিউয়ের মধ্যেও ঐ মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশ, আর্মি, বিডিআর গাড়ির টহল থাকা সত্ত্বেও উত্তেজিত জনতা লাশ নিয়ে মিছিল করছে। যেকোন সময় পুলিশের উপর আক্রমণ হতে পারে।

পুলিশ কন্ট্রোল রুমে উর্ধতন অফিসারবৃন্দ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সকল টহল পার্টি সরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। ঐ এলাকা মিছিলকারীদের দখলে চলে গেল। পুলিশের সাদা পোশাকে থাকা গোপন সংবাদ সংগ্রহকারী সদস্যরাও ঐ এলাকা ছেড়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান নিলেন। সুতরাং ওখানকার সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। উর্ধতন অফিসারবৃন্দ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক প্রকার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন। সরকারের উপর মহল থেকে প্রকৃত ঘটনা জানানোর জন্য তাগিদ আসতে লাগলো।

এক পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার মহোদয় আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি সবার সামনে আগের রাতে লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধারের জন্য আমার প্রশংসা করে বললেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রকৃত ঘটনা জানানোর জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে বার বার রেড টেলিফোনে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু আমি তাঁকে সঠিক তথ্য দিতে পারছি না। তুমি যদি ওখানে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জেনে আসতে পারো তাহলে আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে পারবো। তবে, খুব সাবধানে কাজটি করতে হবে। তোমার নিজের নিরাপত্তা আগে দেখবে। মিছিলকারীরা তোমাকে চিনে ফেললে বিপদ হতে পারে’।

আমি ভয়ে ভয়ে রাজি হলাম। আমার পরনে ছিল একটি টি-শার্ট, যা দেখলে পুলিশ মনে হয় না। ডিবিতে চাকরি করায় মাথার চুল লম্বা ছিল। সর্বোপরি কর্তব্যের তাড়নায় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের অনুরোধে পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে পড়লাম। সমগ্র এলাকা মিছিলে মিছিলে একাকার। আমিও মিছিলকারীদের সাথে সামিল হলাম। টিএসসি এলাকায় গিয়ে জানতে পারলাম, যিনি গুলিতে মারা গেছেন তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গেছে। আমি দ্রুতবেগে মর্গের দিকে ছুটে গিয়ে দেখলাম চাঁনখারপুল এলাকায় একটি মাইক্রোবাসে মিছিলকারীরা আগুন দিয়েছে। রাস্তার উপর মাইক্রোবাসটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঐ মাইক্রোবাসের যাত্রীরা রাস্তার মধ্যে কান্নাকাটি করছেন। তাদের একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, একটু আগে গুলিতে যিনি নিহত হয়েছেন তার মা ও আপনজনেরা লাশ নেওয়ার জন্য যে মাইক্রোবাস নিয়ে আসছিলেন সেই মাইক্রোবাসে মিছিলকারীরা আগুন দিয়েছে।

আমি সুযোগ বুঝে নিহত ব্যক্তির নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে তাদেরকে মর্গের দিকে নিয়ে গেলাম। কারণ নিহত ব্যক্তির লাশ কোথায় আছে তা আমি আগেই জানতাম। নিহতের পরিবারের সাথে একত্রিত হয়ে মর্গের কাছে গেলে তারা লাশ দেখে নিশ্চিত হলেন। নিহত ডাক্তার মিলনের মায়ের কান্নায় আমারও কান্না এলো। ছেলের লাশ নিতে এসে তাদের মাইক্রোবাসটিও মিছিলকারীরা না বুঝে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

ইতোমধ্যে মর্গের চারপাশে অনেক লোকের আগমন হলো। আমার পূর্ব পরিচিত একজন সাংবাদিক আমাকে দেখে চিনে ফেললেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কামরুল ভাই, আপনি এখানে কেন? মিছিলকারীরা আপনাকে চিনলে পিটিয়ে মেরে ফেলবে’।

আমার শরীর শিউরে উঠলো। আমি তার মুখ চেপে ধরে বললাম, ‘নিহতের সকল তথ্য আমি নিয়েছি। আপনি যা যা চান সব আমি আপনাকে দিবো। চলেন এখান থেকে সরে পড়ি। দয়াকরে আমার সাথে পুলিশ কন্ট্রোল রুম পর্যন্ত চলুন।’

তিনি আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমাকে নিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দিকে দ্রুত গতিতে হাটতে থাকলেন। সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মিছিলে মিছিলে একাকার। আমি ভাবতে লাগলাম, আমার যদি কিছু হয় তাহলে এই সাংবাদিক ভায়ের কল্যাণে হয়তো জায়গামতো খবরটা পৌঁছাতে পারে।

আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা নিরাপদে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে গেলাম। মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে সবিস্তারে সকল ঘটনা জানানোর পর তিনি রেড টেলিফোনে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সকল তথ্য সরবরাহ করলেন।

আনন্দ

আমি একজন ছোটখাটো অফিসার হলেও আমার গুরুত্ব ছিল পদের তুলনায় অনেক বড়।

জরুরি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমার যথেষ্ট ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিল।

সকল উর্ধতন অভিসারবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাকে স্মরণ করতেন।

পুলিশের সংকটে আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম।

কারফিউ চলাকালে শত ঝুঁকির মধ্যে আল্লাহর রহমতে আমার কোন বিপদ হয়নি।

বেদনা

আমি যখন এটা লিখছি তার আগেই তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা স্নেহের পল দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন।

আমার জানামতে ঐ আন্দোলনের সময় এমন কিছু মানুষ নিহত হয়েছিলেন যাদের নাম কেউ জানতো না। তাঁদের লাশেরও কোন হদিস হয়নি।

আমার প্রিয় এসি জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব (যিনি আমাকে সিনিয়র অফিসারবৃন্দের কাছে যোগ্য বলে তুলে ধরতেন) তিনিও দুনিয়ায় নাই। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!