দেশে সড়ক ও রেলপথে দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। সড়কের পাশাপাশি রেললাইনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। ট্রেন যাত্রা নিরাপদ করতে নতুন তিনটি বিষয় নিয়ে ‘রেলওয়ে সেফটি সিস্টেম’ আবিষ্কার করেছেন খুলনার সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের একাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী।
এটি বাস্তবায়ন হলে ট্রেন যাত্রায় দুই কিলোমিটার আগেই মিলবে সতর্কতা সংকেত। আগুন নেভাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসবে পানি। অভিনব এই সিস্টেম তৈরি করেছেন বিএল কলেজের ক্ষুদে বিজ্ঞানী তৌফিকুল ওয়াজেদ ও রাজিন বিন মাকসুদ। স্বল্প খরচেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে তারা জানিয়েছেন। এটি বাস্তবায়ন হলে রেলওয়ে সেক্টরে পরিবর্তন আসবে। এড়ানো যাবে দুর্ঘটনা।
ক্ষুদে বিজ্ঞানী রাজিন বিন মাকসুদ বলেন, এটি তিনটি প্রজেক্টের কম্বাইন্ড। ট্রেনের পাতটি লোহার। লোহার ওপর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হয়। আমরা এখানে একটি সিস্টেম তৈরি করেছি। রেল থেকে একটি তড়িৎ দুই কিলোমিটার দূরে পাঠানো হবে সেন্সরের মাধ্যমে। তড়িৎ রিসিভ হলে বোঝা যাবে বর্তনীটা ঠিক আছে। বর্তনী কাটা নেই বা বিচ্ছিন্ন নেই। তবে যদি তড়িৎ না পৌঁছায় তখন বোঝা যাবে বিচ্ছিন্ন আছে। তখনই ট্রেন ব্রেক করবে, সাইরেন দেবে এবং বুঝতে পারবে সামনে কোনো সমস্যা রয়েছে। তখন ট্রেন থেমে যাবে। এছাড়া দ্বিতীয় প্রজেক্টটি হচ্ছে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে গ্যাস সেন্সর, ফ্রেম সেন্সর এবং লাইট সেন্সর আছে। ফলে ভেতরে যদি আগুন ধরে তাহলে ভেতরে থাকা মোটর অটোমেটিক পানি দেবে, আগুন নিভে যাবে। তৃতীয় প্রজেক্টটি হচ্ছে দুই দিক থেকে যদি দুটো ট্রেন আসে তাহলে দুটি সেন্সরের মাধ্যমে ২ কিলোমিটার আগে সংকেত দেবে। যতই দ্রুতগামী হোক না কেন দুই কিলোমিটারের মধ্যে থেমে যাবে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটবে না।
আরেক ক্ষুদে বিজ্ঞানী তৌফিকুল ওয়াজেদ বলেন, কোনো ট্রেনের যাত্রী চাইবে না যে সে দুর্ঘটনার শিকার হোক। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং সঠিকভাবে চলাচল করতে অবশ্যই এই প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা ট্রেনকে এই সিস্টেমের আওতায় আনা উচিত। এমন সিস্টেম আমরা আগে পড়ে দেখিনি। আমরা দুইজন ভেবে এটা করেছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেলওয়ের মাধ্যমে দেশের বেশিরভাগ মানুষ যাতায়াত করে। সম্প্রতি দুটি ট্রেন দুর্ঘটনা এবং ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনা থেকে এই চিন্তা মাথায় এসেছে। এটি বাংলাদেশের রেলওয়ে সিস্টেমের আওতায় আনতে এক কোটি ৬৭ লাখ টাকার মতো ব্যয় হতে পারে। বাকি আনুষঙ্গিক খরচ করলে ব্যয় আরেকটু বেড়ে যেতে পারে। কিন্ত খুব বেশি হবে না।
দর্শনার্থী শিমুল কুমার দাস বলেন, ট্রেন যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা একটি কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন সিস্টেমগুলো চালু করলে ট্রেনের ক্ষেত্রে সমস্যা নিরসন করা যায় সেই বিষয়ে এই প্রজেক্ট। এটা একটি যুগান্তকারী প্রজেক্ট। এখানে যতগুলো প্রজেক্ট দেখেছি, তার মধ্যে এটি আমার কাছে মনে হয়েছে বেস্ট।
বিএল কলেজের বোটানি ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুন বলেন, বর্তমানে সড়ক ও রেলপথে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এই দুর্ঘটনা এড়াতে বিএল কলেজের শিক্ষার্থীরা যে উদ্যোগটা নিয়েছে এটা যুগোপযোগী। এই উদ্যোগটা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আমাদের ট্রেনের নিরাপত্তা জোরদার হবে। একইসঙ্গে যাতায়াত আরামদায়ক হবে।
দর্শনার্থী সুমা আক্তার বলেন, এই সিস্টেমটা থাকলে দুর্ঘটনা খুবই কম ঘটবে। তারা যে সেন্সরগুলো লাগিয়েছে, তা সিগনাল দেবে। এটি ভালো জিনিস। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গ্যাস লিকেজ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেন্সর মেপে সেই অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা যাবে। এটা খুবই যুগোপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রজেক্ট বাংলাদেশে হোক। যাতে আমাদের সড়ক দুর্ঘটনা কমে যায়।
বিএল কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র শীল বলেন, এই প্রকল্পটির মাধ্যমে যদি আমরা আগে থেকে বুঝতে পারি চালক নিশ্চয় সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি সময়োপযোগী। বিশেষ করে ট্রেনে মাঝে মাঝে আগুন লাগছে, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এই প্রকল্প যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে না। মানুষের জীবন রক্ষা পাবে।
আয়োজকরা জানান, বিএল কলেজে গত রোববার শুরু হওয়া এই বিজ্ঞান মেলা চলবে আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত। মেলায় খুলনা শহরের ২০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০টি প্রজেক্ট প্রদর্শনী চলছে। এখানে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন উদ্ভাবনী ছোট ছোট প্রজেক্টগুলো প্রদর্শন করছে। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার জন্য এই মেলার আয়োজন। এই প্রজেক্টগুলো থেকে দুটি ধাপে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। এছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও কুইজ প্রতিযোগিতা রয়েছে। এসবেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে।
খুলনা গেজেট/ এএজে