চিংড়ির তুলনায় ঝুঁকি কম হওয়ায় সাতক্ষীরায় মিঠাপানির মাছ চাষ ক্রমশ বাড়ছে। জেলার বেশ কয়েকটি নদী নব্যতা হারিয়ে ফেলায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষের প্রয়োজনীয় লোনা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে চাষীরা লোনা পানির চিংড়ির পরিবর্তে সেখানে মিঠা পানির সাদা মাছ চাষ শুরু করেছেন। আবার অনেকে ঘের ভাগ করে কিছু জমিতে বাগদা ও গলদা চিংড়ি এবং বাকি জমিতে সাদা মাছ চাষ করছেন। সাদা মাছ চাষে অপেক্ষাকৃত ঝুকি কম থাকায় অনেক চাষীরা তাদের ঘেরে চিংড়ির পরিবর্তে মিঠাপানির মাছ চাষ করছেন।
জানা যায়, সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত। কম খরচে অধিক লাভ, পোনা ও লোনাপানির সহজলভ্যতা ও বিদেশে বাজার সৃষ্টি হওয়ায় আশির দশক থেকে দেশের উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ব্যাপক ভাবে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের মোট চিংড়ি চাষের প্রায় ৬০ ভাগ চিংড়ি উৎপাদন হয় সাতক্ষীরায়। এই জেলার কয়েক লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই চিংড়ি চাষের সাথে জড়িত। কিন্তু জলাবায়ুর পরিবর্তনের ফলে চিংড়ি ঘেরে ভাইরাসসহ নানা রোগে প্রায় এক দশক ধরে দেশে চিংড়ি উৎপাদন একরকম নিন্মমুখী। করোনা মহামারী ও বিশ্ব মন্দার প্রভাবেও লোকসান গুনতে হচ্ছে চিংড়িখাত সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া লোনাপানির আগ্রাসনে জেলার জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে অনেকে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ অবস্থায় জেলার চাষীদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে মিঠাপানির মাছ।
চিংড়ির তুলনায় ঝুঁকি কম থাকায় সাতক্ষীরায় মিঠাপানির মাছ চাষ বাড়ছে। অনেক চিংড়ি চাষী মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। জেলায় বর্তমানে রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্লাসকার্প, সিলভারকার্প, পাবদা, কালিবাউস, ব্লাককার্প, বাটা, মনোসেক্স ও জাপানি রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে বছরে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হচ্ছে এই জেলায়। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, জেলার কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষের সরাসরি জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে সাদা বা মিঠাপানির মাছ উৎপাদন করে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যানুযায়ী চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৬০ হাজার হেক্টর পরিমাণ জমির ৬৩ হাজার ২০০টি ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ হচ্ছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০০ টাকা কেজি দরে গড় দেশীয় বাজার মূল্য ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এদিকে গত বছর একই পরিমাণ ঘেরে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার টন। যার বাজার মূল্য ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুই-তিন বছরের ব্যবধানে জেলায় মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ।
সাতক্ষীরার সদর উপজেলার জেয়ালা গ্রামের মৎস্যচাষী আব্দুল গফুর জানান, ১২ বছর ধরে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ চাষ করে আসছেন, কিন্তু চিংড়ি চাষে অব্যাহতভাবে লোকসান করার পর গত সাত-আট বছর ৮০ বিঘা পরিমাণ জমির ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ করছেন। উন্নত জাতের রুই, কাতল, মৃগেল, সিলভার কার্প, বাটাসহ অন্যান্য প্রজাতির সাদা মাছ উৎপাদন করেন তার ঘেরে। জমির লিজ মূল্য, মাছের পোনা ক্রয়, খাদ্য, শ্রমিকের বেতনসহ অন্য খরচ উঠিয়েও বছরে ২৫-৩০ লাখ টাকা লাভ হয় তার। তিনি এখন আর লোনাপানির চিংড়ি চাষ করেন না।
একই উপজেলার চুপড়িয়া এলাকার চাষী তানজির আহমেদ জানান, চার-পাঁচ বছর যাবত ৪৫ বিঘা পরিমাণ জমির ঘেরে বিভিন্ন ধরনের মিঠাপানির মাছ চাষ করেন। এর মধ্যে রয়েছে রুই, কাতল, পাবদা, পাঙাশ, কালিবাউস ও অন্য কার্পজাতীয় মাছ। গত মৌসুমেও একই পরিমাণ ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ করেন। সব খরচ তুলে তার ১২ লাখ টাকা লাভ হয়। ফলে আগামীতে আরও বড় পরিসরে মিঠাপানির মাছের ঘের করবেন।
সাতক্ষীরার বিশিষ্ঠ মৎস্য বাবসায়ি দীন বন্ধু মিত্র বলেন, দেবহাটা উপজেলার বড়বড়িয়া এলাকায় ৬শ বিঘার একটি মাছের ঘের রয়েছে তার। সেখানে ২০টি পুকুরে তিনি বিভিন্ন ধরনের সাদা মাছ চাষ করেন। বাকি জমিতে বাগদা ও গলদা। লোনা পানির সংকটের কারণে তিনি এবার সাদা মাছের চাষ আরও বাড়িয়েছেন। সাদা মাছ চাষে ঝুকি কম হওয়ায় আগামীতে তিনি আরও জমিতে মিঠাপানির সাদা মাছ চাষ করবেন বলে জানান।
মিঠাপানির এসব মাছ কিনতে জেলার আড়তগুলোয় আসছেন অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীরা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিনেরপোতা মৎস্য আড়ত জেলার মধ্যে বৃহত্তম। এছাড়া সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড়বাজার আড়ত, সদর উপজেলার ব্যাংদহা বাজার আড়ত, দেবহাটার গাজীরহাট আড়ত, আশাশুনি উপজেলার মহেশ্বরকাঠি আড়ত, খুলনা-বাইপাস সড়কের পাশে বকচরাসহ জেলার প্রায় ২৫০টি মৎস্য আড়ত ভোর থেকেই বেচাকেনা জমে ওঠে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, জেলায় মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে। জেলার প্রায় ২৫০ মৎস্য আড়তে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মিঠাপানির মাছ বিক্রি হচ্ছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, চিংড়ি উৎপাদনে মৎস্যচাষীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু মিঠাপানির মাছ চাষে তেমন ঝুঁকি থাকছে না। ফলে দিন দিন বাড়ছে মিঠাপানির মাছ চাষ ও বাজার।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, জেলায় কার্পজাতীয় মিঠাপানির মাছের উৎপাদন ও বাজার প্রসার হচ্ছে। বিশেষ করে করোনার পর থেকে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদার পাশাপাশি দাম কমে যাওয়ায় চাষীরা মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে ঝুঁকে পড়ছেন। তিনি আরও জানান, জেলায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মিঠাপানির মাছের দেশীয় বাজার তৈরি হয়েছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন বাড়াতে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষীদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি সহযোগিতা করা হচ্ছে। বর্তমানে এ জেলায় বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হচ্ছে। যার গড় দেশীয় বাজারমূল্য ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
খুলনা গেজেট/ এসজেড