খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ পৌষ, ১৪৩১ | ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  আরও ৬০ দিন বাড়ল সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা
  রমজান ও ঈদের সম্ভাব্য তারিখ জানাল আরব আমিরাত
  দেশে একজনের শরীরে এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত : আইইডিসিআর

ঝুঁকিপূর্ণ সাতক্ষীরা উপকূলের ৫২ কিমি বেড়িবাঁধ, জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

ভারতীয় স্থলভাগে থাকা সুস্পষ্ট লঘুচাপ আরও দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত হওয়ায় এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃহস্পতিবারও (১১ আগষ্ট) বায়ুচাপের পার্থক্য বিরাজ করছে। এজন্য সমুদ্র বন্দরগুলোতে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। লঘুচাপ ও বায়ুুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২-৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে সাতক্ষীরা জেলার উপকূলজুড়ে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো)’র ৫২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

সাতক্ষীরার উপকলীয় এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে উপকূলীয় এলাকার শতাধিক কিলোমিটার পাউবো’র বেড়িবাঁধ। শুস্ক মৌসুমে যখন বেড়িবাঁধ মেরামত করার সুযোগ থাকে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মেরামত করে না। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অনেক স্থানেই বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কোথাও কোথাও ঠিকাদাররা দায়সারাভাবে বাঁধের মেরামত কাজ শেষ করে। ফলে দুর্যোগে সহজেই ঔসব বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

পাউবো’র তথ্যানুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় মোট ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ৮২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে পাউবো বিভাগ-২ এর আওতায় খুলনা জেলার কয়রা এলাকায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিপূর্ণ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি ওই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া ও প্রায় ৬০ ফুট তলা। কিন্তু এখন ওই ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। অর্থাভাবে দীর্ঘদিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ষাটের দশকে তৈরি ওই বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বাঁধগুলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নচাপ, লঘুচাপ, আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে লোকালয়ে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। ফলে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশাশুনির কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, লবণাক্ত মাটি দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বেড়িবাঁধের মাটির বন্ডিং দুর্বল করে ফেলে। অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে বাঁধের মাটি ধুয়ে যায়। তাছাড়া বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণপানি তোলার কারণেও বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। তাছাড়া উপকূলীয় নদীগুলোতে পলি পড়ে নাব্যতা কমে গেছে। ফলে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েছে। তাছাড়া প্রতিবছর গড়ে প্রায় দু’বার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানছে। তখন জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৫ ফুট বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ওই বাঁধ দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে যে বেড়িবাঁধ রয়েছে তা দিয়ে উপকূলীয় জনপদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেজন্য নতুন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, ষাটের দশকে নির্মাণ করা বেড়িবাঁধ এখন আর কোথাও নেই। বর্তমানে জেলার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কম এবং সেগুলোর মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন বেড়িবাঁধ নিার্মণ ও সংস্কার করার সময় খাড়াভাবে মাত্র ১০-১২ ফুট উঁচু ও ৮ ফুট চওড়া করা হয়। এছাড়া স্কেবেটর মেশিন দিয়ে দায়সারা গোছের কাজ করা হয়। যে কারণে বাধেঁর স্থায়িত্ব খুবই কম।

বর্তমানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে ব্যপাক অনিয়ম হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁধ নির্মাণের কাজ ছেড়ে দেন লেবার সর্দ্দারের কাছে। অনেক সময় পাউবো’র সেকশান অফিসাররা বেনামে কাজ করে থাকেন। এতে করে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা ব্যায় না করে অনিয়মের মাধ্যমে তা চলে যায় ঠিকাদার ও পাউবো’র কিছু অসাধু কর্মকতার পকেটে। তিনি উপকূল এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, চারি-পাশে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত তার ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের গাবুরা, নাপিতখালি, জেলেখালি, তিন নম্বর পোল্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সাগরে নিম্মচাপের প্রভাবে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া। নদীতে জোয়ারের সময় বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। জোয়ারের সময় বাঁধের কানায় কানায় পানি উঠছে। ফলে এ অবস্থা থাকলে যেকোনো সময় এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে।

আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যন শেখ জাকির হোসেন জানান, সিডর, আইলা, বুলবুল, ইয়াস ও আম্ফানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এই ইউনিয়নের অর্ধেক অংশ প্রায় ৬ মাস ধরে নদীর পানিতে প্লাবিত হয়ে ছিল। ইউনিয়নের বহু মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছে। কপোতাক্ষ নদের তীব্র জোয়ারের প্রভাবে ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া এলাকায় পাউবো’র বেড়িবাঁধে ইতিমধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পাউবো’র দায়সারা গোছের কাজের কারণে বাঁধের স্থায়িত্ব কম হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, তার বিভাগের অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বাঁধের ৪২ কিলোমিটার। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দূর্গাবাটি, দাতনেখালী, দেবহাটার ভাতশালা ও হাড়দ্দহা ইত্যাদি। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বেড়িবাঁধ মেরামত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, তার বিভাগের অধীনে প্রায় ৪০০ কিলোমটিার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাধেঁর মধ্যে সাতক্ষীরার মধ্যে রয়েছে মাত্র ১০ কিলোমিটার। বাকি ৩০ কিলোমিটার খুলনার কয়রার মধ্যে। সাতক্ষীরায় তার এলাকার মধ্যে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়া, শ্রীউলা ও আশাশুনি সদরের কিছু অংশ এবং শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বেশ কিছু বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সাগরের নিম্মচাপের প্রভাবে নদ-নদীতে জোয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধের উপর আমাদের নজরদরী রয়েছে। আমি নিজে শুক্রবার ৭/২ পোল্ডার এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পরিদর্শনে যাবো। এছাড়া পাউবো’র পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধ মেরামতের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

খুলনা গেজেট / আ হ আ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!