নদীতে জোয়ার আসলেই ভাঙা বাঁধ দিয়ে এখনো লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। পানিতে ভেসে যাচ্ছে পুকুর-ঘের। তলিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি, রাস্তা-ঘাট। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসী গ্রাম, পাইকগাছা উপজেলা ও কয়রার দশহালিয়াসহ খুলনা উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসী গ্রামের বাসিন্দা মিলন কান্তি মন্ডল ও নিয়ামত শেখ আলী বলেন, বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণপানি প্রবেশ করেছে। এবারের ঝড় দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এতক্ষণ কোনো ঝড় কখনো দেখিনি। বাঁধটি আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের চেষ্টা করছি। এখানের ছয়টি পয়েন্টা বাঁধ ভেঙেছে। জোয়ার আসলেই এসব পয়েন্ট থেকে পানি প্রবেশ করে লোকালয় তলিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ ও ঘের তলিয়ে যায়। রান্না ঘরও তলিয়ে গেছে। কিছু রান্না করে খাব সেই অবস্থা নেই। মুড়ি-চিড়ে খেয়ে বাঁধ মেরামতে কাজ করছি। লবণ পানির কারণে গাছ মারা যাচ্ছে।
তারা বলেন, পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। অনেকস্থানে রুই-কাতলা ও মৃগেল মাছ মরে ভাসছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দেয় কিন্তু বাঁধ নির্মাণ হয় না। আমরা টেকসই মজবুত বেড়িবাঁধ চাই। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি চাই।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন গাজী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ইউনিয়নের অধিকাংশ জায়গা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মানুষ অনেক কষ্টে রয়েছে। ভাঙা বাঁধের ৬-৭টি পয়েন্ট থেকে এখনো জোয়ারের পানি ঢুকছে। মানুষ রাস্তায় রান্না করে খাচ্ছে। ২০০/৩০০ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। তবে জোয়ার আসলে আবারও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা। এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২১টি স্থানে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে বাঁধ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের বাসিন্দা বিজন বিহারী সরদার বলেন, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের গল্প শুনি। কিন্তু আমাদের বাঁধের কিছু হয় না। লবণ জলে ডুবতে ডুবতে জীবন শেষ। লবণের চিংড়ি চাষ থেকে বাঁচতে চাই। এতো ক্ষতি, কোনো ক্ষতিপূরণও পাই না। আমাদের এ দুযোর্গ থেকে বাঁচান।
বুধবার (২৯ মে) দুপুরের জোয়ারের পর কয়রার দশহালিয়া এলাকার মেরামত করা বাঁধটি ফের ভেঙে যায়। ফলে ওই গ্রামের প্রায় ২৫০ পরিবারের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হয়েছে।
বাঁধ মেরামতের কাজে আসা লোকজন জানান, মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড় রেমালের দাপট কমে যায়। এ সময় কপোতাক্ষ নদে জোয়ারের চাপও একটু কমে আসে। ওই সময় গ্রামের মানুষ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বাঁধ মেরামতে লেগে পড়ে। প্রথম দিনে ভেঙে যাওয়া বাঁধের নিচের অংশে বাঁশের চালা পুঁতে সেখানে বালুর বস্তা ফেলে রাখা হয়। এতে লোকালয়ে পানির চাপ অনেকাংশে কমে যায়। এ অবস্থায় বুধবার সকালে দুই শতাধিক মানুষ মূল ভাঙন মেরামতে কাজ শুরু করে। দুপুরের আগেই বাঁধটির ৮০ ভাগ মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে নদীতে পূর্ণ জোয়ারের সময় পানির চাপে তা ভেঙে যায়।
ওই বাঁধ মেরামত কাজে অংশ নেওয়া স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসক নুরুল ইসলাম জানান, কাজ করার মানুষ যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সময় মতো কাজের সরঞ্জামাদি জোগান দিতে পারেনি পাউবোর কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বালু ভর্তি বস্তার অভাবে মেরামত সম্পন্ন বাঁধটি টিকিয়ে রাখা যায়নি। বাঁধের ঢালে বালু ভর্তি বস্তাগুলো ফেলা গেলে বাঁধটি হয়তো টিকে থাকত।
পাউবোর কয়রার দায়িত্বশীল উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, মেরামত কাজে যাদের বালু সরবরাহের কথা ছিল শেষ মুহূর্তে এসে তারা ব্যর্থ হন। তবুও এলাকার মানুষকে সাথে নিয়ে বাঁধটি মেরামতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে যেখান থেকে বাঁধ ভেঙেছে সেখানে আগে ডাম্পিং করা কিছু সিনথেটিক ব্যাগ মাটির সঙ্গে মিশে আছে। তার ওপরে পুনরায় মাটি চাপা দেওয়া হয়। জোয়ারের চাপে ব্যাগের ওপরের অংশের মাটি ধসে যাওয়ায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা গেজেট/এমএম