খুলনা, বাংলাদেশ | ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : রায় কবে জানা যাবে আজ

জলাবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ : প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, ঋণ না-কি অনুদান?

বাহলুল আলম

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কাঠামো কনভেনশনের (ইউনএফসিসিসি) আওতায় ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর Conference of Parties (COP) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নিয়ম করে এবারও কপের ২৯তম সম্মেলন হয়ে গেলো (১১-২২ নভেম্বর) কাস্পিয়ান সাগরতীরবর্তী দেশ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। এবারের এই সম্মেলন-কপ’২৯ কে ‘কপ অব দ্য ফিন্যান্স’ বা অর্থায়নের কপ বলা হলেও সেটি কেবল কাগজে-কলমেই ঠেকেছে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছে অনুদান (ঋণ নয়) হিসেবে পাঁচ লাখ কোটি ডলার দাবি করেছিলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জোট জি-সেভেনটি সেভেন প্লাস। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক এই নতুন অর্থায়ন লক্ষ্য ঠিক করেছিলো তারা। তবে কপ-২৯ সম্মেলনে এই প্রশ্নে একমত হতে পারেনি।

উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো; বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। এই জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলো দীর্ঘ আলোচনার পর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার (ঋণ না-কি অনুদান পরিস্কার নয়) অঙ্গীকার করেছে। যদিও জাপান, সুইজারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড এর বিরোধিতা করে। যা সম্মেলনে থাকা ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করেন। জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এই অঙ্ককে ‘তামাশা’, ‘লজ্জাজনক’, ‘আপত্তিকর’ বলে মন্তব্য করেন।

পানামার প্রতিনিধি হুয়ান কার্লোস মন্টেরি গোমেজ গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই যথেষ্ট না। আমাদের বছরে অন্তত পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা চেয়েছি এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র এক শতাংশ। এই সাহায্যের পরিমাণকে ‘অপমানসূচক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সমালোচকরা। কপ-২৯ কে একটি ‘ব্যর্থ সম্মেলন’ বলে দাবি করেছেন সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ‘পাপুয়া নিউগিনি’ এবারের জলবায়ু সম্মেলন বয়কট করেছে । পূর্বের ন্যায় এবারও হতাশাজনক ফলাফল নিয়ে শেষ হয়েছে কপ ২৯ সম্মেলন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূনরায় নির্বাচিত হওয়া। কাকতালীয় হলেও ঘটনা হলো, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভাও কপ-২৯ এ আসেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-ও কপ-২৯ এ যোগ দেননি। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও মার্কিন প্রেসিডেন্টের পথ অনুসরণ করছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ সম্মেলনে যোগদানই করেননি। এ বছর ৮৫,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করলেও তার মধ্যে ১ হাজার ৭৭৩ জন জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টকে (তদবিরের লোকজন) সম্মেলনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে সম্মেলনে জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মাত্র ১ হাজার ৩৩ জন প্রতিনিধিযোগ দিয়েছে। আগামী বছরের কপ-৩০ এর আয়োজক ব্রাজিল ছাড়া প্রতিটি দেশ থেকে কপ সম্মেলনের প্রতিনিধির থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের সংখ্যা বেশি। রাজত্ব করছেন কয়লা, তেল ও গ্যাস শিল্পের প্রতিনিধিরা। জীবাশ্ব জ্বালানি শিল্পের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি থাকা দেশের প্রতিনিধিদের সংখ্যাকে পেছনে ফেলছে। আন্তর্জাতিক এমিশনস ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন সবচেয়ে বেশি লবিস্ট নিয়ে এসেছে। তাদের ৪৩ জন প্রতিনিধির মধ্যে তেল কোম্পানি টোটাল এনার্জি ও গ্লেনকোরের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। যুক্তরাজ্য একা ২০ জন লবিস্ট পাঠিয়েছে।

অন্যদিকে, জাপান তাদের কয়লা প্রতিষ্ঠান সুমিতোমোর একজন প্রতিনিধি, কানাডা সানকো ও ট্যুরমালিনের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে এবং ইতালি এনার্জি কোম্পানি এনি ও এনেলের কর্মীদের নিয়ে এসেছে। প্রধান তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি শেভরন, এক্সন–মোবিল, বিপি, শেল ও এনি কপ–২৯ সম্মেলনে মোট ৩৯ জন লবিস্ট পাঠিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের চালানো গণহত্যার সহযোগী। কেন না তারা ইসরায়েলে তেল সরবরাহ করে। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী ঐ শিল্পসমূহের এত প্রতিনিধির জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ জলবায়ুকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানা যায়। সম্মেলন শেষে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোলস- এনসিকিউজি)এর মতো বিষয়গুলোয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সম্মেলনেও ধনী দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে অর্থায়ন করবে কিনা তা এখন বড় প্রশ্ন। এমনকি বিগত বছরগুলোর ক্ষতিপূরণের বিষয়ে মেলেনি কোনো আশ্বাস। কপ-২৯ সম্মেলনে অর্থায়ন নিয়ে একমত হতে পারেনি উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। কারণ উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে বিনিয়োগে লাভের নিশ্চয়তা চায়। যেমন বাংলাদেশকে যদি কোনো উন্নত দেশ জলবায়ু পরবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১০০ ডলার ঋণ দেয় নির্দিষ্ট সময় পর এই সুদসহ এই অর্থ বাংলাদেশ ফেরত দিতে পারবে কিনা সেই নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তা না দিতে পারলে ঋণও অনিশ্চিত থেকে যাবে।

আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলন শেষে দেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। প্যারিস চুক্তিতে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। অর্থছাড় বা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিগত বছরগুলোয় উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে; ২০০৯ সালের কপ-১৫ কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব মোকাবেলা করনীয় বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছিল। ২০১৫ সালের কপ-২১ সম্মেলনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে এবং ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা, এ লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা যা পরবর্তী সম্মেলনগুলোর গৃহীত অঙ্গীকারগুলোও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি । কপ-২৬ সম্মেলনে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কপ-২৭ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ নামে একটি বিশেষ ফান্ড গঠনের বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছিল। ২০২৩ সালে দুবাইতে কপ-২৮ সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে প্রায় ৭০ কোটি ডলার অনুদানের অঙ্গীকার করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যায়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা ও মানবিক সদিচ্ছার অভাবে এই প্রকল্প যথাযথ আলোর মুখ দেখতে পায়নি।

বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় অন্তত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে তাপমাত্রা। উষ্ণতম দশক পার করছে বিশ্ব। ২০২৩ সালে ৫৭.৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের তথ্য জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন ২০১৫ সালের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি হবে, যদিও নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আগামীর বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো একক রাষ্ট্রের বা বিশেষ কোনো অঞ্চলের সমস্যা নয়, বরং একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। তাই ।

বৈশ্বিক এই সম্মেলনটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর টিকে থাকতে এ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজন ট্রিলিয়ন ডলার। আর্থিক সহায়তার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা এবং বিপর্যস্ত দেশগুলোর দর-কষাকষির বিষয়টির তীব্র সমালোচনা করছেন। সম্মেলনে তিনি তার দীর্ঘদিনের লালিত বিগ থ্রি জিরোর ধারণা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে একটি ভিন্ন জীবনধারার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানবসভ্যতা রক্ষায় আমাদের শূন্য কার্বন নিঃসরণ, সম্পদের শূন্য পুঞ্জীভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব এই তিন শূন্য তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। জলবায়ু সমস্যার সমাধানে পানির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব দেন। তিনি নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির আহ্বান জানান।

সার্বিকভাবে, কপ ২৯ সম্মেলন কিছু প্রস্তাবনায় অগ্রগতি আনলেও কার্যকর পরিবর্তনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ হাত ছাড়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব। এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞের মতে, ফলে কপ২৯-এর শেষ সময়ে অর্থছাড়ের বিষয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বরাদ্দকৃত ৩০০ বিলিয়ন ডলারকে অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায়ও নেই। এছাড়াও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি এলডিসির জন্য কোনো বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করা হয়নি। এই তহবিলে পরিচালনার ভার পূর্বের ন্যায় হয়তো বিশ্বব্যাংকের হাতে থাকা নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ রয়েছে। যদি অনুদানের পরিবর্তে ঋণ হিসেবে বরাদ্দের পলিসি গ্রহন করা হয় তাহলে পূর্বের ন্যায় দুর্বল দেশগুলোর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা পূরণে অনুদানের ভিত্তিতে তহবিলের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর হোক, রাজনীতির কুট-চাল থেকে মুক্ত রাখা হোক আমাদের এ ধরিত্রী-কে।

লেখক : জলবায়ু পরিবর্তণ বিষয়ে  কর্মরত উপকূলীয় বাসিন্দা

খুলনা গেজেট/কেডি




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!